তিনি পাশাপাশি দুই সাগর প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরাল, যা তারা অতিক্রম করে না।’ (সূরা ৫৫ আর-রাহমান, আয়াত: ১৯-২০)
আরবি
ভাষায় বারযাখ (برزخ) শব্দের অর্থ বাঁধা বা অন্তরাল। এই
অন্তরাল কোনো বস্তুগত বিষয় নয়। আরবিতে মারাজা (مرج) শব্দের অর্থ করলে বোঝায় দুটি বস্তুর পরস্পর মিলিত হয়ে মিশ্রিত হয়ে যাওয়া।
আধুনিক
বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, দুটি ভিন্ন সাগরের পানি যেখানে একত্রিত হয়, সেখানে তাদের মধ্যে একটি ব্যবধান থাকে। এই ব্যবধান উভয়
সাগরের জলরাশিকে এমনভাবে বিভক্ত করে যে, তারা তাদের নিজস্ব তাপমাত্রা, মিষ্টতা বা লবণাক্ততা এবং
ঘনত্ব বজায় রেখেই পাশাপাশি চলতে পারে।
আরো সহজ করে
বললে আপনারা যারা সিলেটে সাত রংয়ের চা দেখেছেন। ঠিক এমটাই হয়ে থাকে এসব মোহনা বা দুই
সমুদ্রের সংযোগ স্থলে।
সমুদ্র
বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার পবিত্র
কোরআনে বর্ণিত আয়াতটির যথার্থ ব্যাখ্যা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি প্রবাহমান দুটি ভিন্ন ভিন্ন সাগরের মধ্যে একটি অদৃশ্য ব্যবধানের অবস্থান রয়েছে, যার ফলে পাশাপাশি প্রবাহিত হওয়া সত্ত্বেও দুটি সাগরের পানি পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায় না।
বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের কলারাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উইলিয়াম হে পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত এই তথ্যটির বৈজ্ঞানিক সততা প্রকাশ করেন।
এ ছাড়াও আধুনিককালে
Marine Science I Oceanology তথা
সমুদ্রবিজ্ঞান এর প্রমাণ পেয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে এর বাস্তব চিত্র
দেখা গেছে। আটলান্টিক মহাসাগরকে ভূমধ্যসাগরের পানির সঙ্গে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু উভয়ের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। ভূমধ্যসাগরের পানি অধিক লবণাক্ত, বিস্বাদ ও ঘন। ভূমধ্যসাগরের
পানি জিব্রাল্টার সেল বা সাগরের তলের
উঁচু ভূমির ওপর দিয়ে আটলান্টিক সাগরের ভেতরে শতাধিক কিলোমিটার প্রবেশ করেছে এবং তা এক হাজার
মিটার গভীরে পৌঁছার পরও তার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যে সামান্য পরিবর্তন হয়নি। অথচ উভয়ের মাঝে রয়েছে প্রবল খরস্রোত ও উত্তাল তরঙ্গ।
কিন্তু পানি মিশছে না। যেন উভয়ের মাঝে পর্দা পড়ে আছে। এ অন্তরায় বর্ণনা
প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে,
এভাবে
আলাস্কা উপসাগরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে দুই ধরনের পানির স্রোতরেখা। এ স্রোতরেখায় প্রবহমান
পানি একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে না। প্রশান্ত মহাসাসাগরের শাখা হচ্ছে আলাস্কা উপসাগর। বিজ্ঞানীদের মতে এ পানি না
মিশার কারণ হচ্ছে তাতে দুই মহাসাগরের সংযোগ ঘটেছে। উপসাগরটির মাঝ বরাবর পানির প্রবাহ আলাদা হয়ে বয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মনির খাশুকজি
এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি বাহরাইন উপসাগরের জলস্রোতে এরকম একটি স্থান দিয়ে অতিক্রম করেছিলাম। নৌকায় চলতে চলতে সেই বাঁধ (প্রাচীর) বরাবর গেলাম। খুব কাছে থেকে উভয় দিকের পানি মুখে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলাম। পরীক্ষায় দেখা গেল, উভয় দিকের পানি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কী আশ্চর্য! একটার
পানি লোনা, বিস্বাদ কিন্তু অপরটির পানি সুপেয়, মিষ্ট ও তৃষ্ণানিবারক। সমুদ্রের
মাঝে এটা এক বিস্ময়কর কুদরত,
যা মহান আল্লাহ তায়ালার অলৌকিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা এতে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছেন। কোরআনের বিশুদ্ধতা অকপটে স্বীকার করেছেন। অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ফ্যান্সের প্রথিতযশা সমুদ্রবিজ্ঞানী জ্যাক ভি কোস্টা (Jack V Costa)। সমুদ্রের
তলদেশের বিভিন্ন আবিষ্কারে তার অবদান অনস্বীকার্য। দুই সমুদ্রের মিলনদৃশ্য নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনি তার রিসার্চে উপলব্ধি করেছিলেন যে, রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর
রাসায়নিক মিশ্রণের গুণাবলি ও মাত্রা দিক
দিয়ে একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি এ বাস্তবতা স্বচক্ষে
প্রত্যক্ষ করার জন্য জিব্রাল্টারের দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে গবেষণা চালালেন। তিনি দেখলেন, জিব্রাল্টারের উত্তর তীর (মারুকেশ) আর দক্ষিণ তীর
(স্পেন) থেকে আশ্চর্যজনকভাবে একটি মিষ্টি পানির ঝরনা উথলে ওঠে। এ ঝরনাটি উভয়
সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ৪৫০ সূক্ষ্ম কোণে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়ে চিরুনির দাঁতের আকার ধারণ করে বাঁধের মতো কাজ করে। ফলে রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের
পানি একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে না।
পরে
তাকে আল কোরআনে বর্ণিত
আয়াতটি শোনানো হলো। তিনি দেখলেন, কোরআনে বর্ণিত তথ্যের সঙ্গে তার গবেষণার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। জ্যাক ভি কস্টা চিন্তা
করলেন, ১৪০০ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর মতো নিরক্ষর
মানুষ সমুদ্রের তলদেশ পর্যবেক্ষণ করে এসব তথ্য কোরআনে লিখতে পারেন না। তাহলে কোরআনে সমুদ্র বিজ্ঞানের এ মহা তথ্য
কীভাবে এলো? নিশ্চয় আল কোরআন ঐশী
সত্য গ্রন্থ।
এটা
কোনো মানব রচিত নয়। Jack V Costa মুসলমান হয়ে গেলেন। পবিত্র কোরআনের এমন অলৌকিকতা সর্বকালে প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিশ্চয় আল কোরআন মীমাংসাকারী বাণী এবং এটি নিরর্থক নয়।' (সূরা ৮৬ আত তারিক : ১৩-১৪)।
অর্থাৎ
পবিত্র কোরআনের প্রতিটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাস্তবতার বিচারে সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ। দুই
সমুদ্রের মিলন সম্পর্কিত বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় সঠিকত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে 'মারাজাল বাহরাইন' শব্দ ব্যবহার করেছেন। 'মারাজা' শব্দের অর্থ হচ্ছে, স্বাধীনভাবে প্রবাহিত করা। ছেড়ে দেয়া। অর্থাৎ দুই সমুদ্রের পানি একই সঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু মাঝখানে আছে দুর্ভেদ্য প্রাচীর, যার ফলে তারা পরস্পর মিশ্রিত হতে পারছে না। প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞানীরা প্রাচীরের ব্যাপারটি স্পষ্ট লক্ষ করেছেন। পবিত্র কোরআনে 'বাঁধ বা অন্তরালের' কথা
এসেছে।
‘তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও অন্যটি লোনা, বিস্বাদ। উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য ব্যবধান।’ (সূরা ২৫ ফুরকান, আয়াত: ৫৩)
পবিত্র কুরআনের
উক্ত তথ্যের বাস্তবতা কমবেশি সব মোহনাতেই লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের চাঁদপুররের রাজবাড়ী বহর' নামক স্থনে এ স্থানে দেখা
যায়, পদ্মা ও মেঘনার পানি
পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। পদ্মার পানি ঘোলাটে আর মেঘনার পানি
কুচকুচে কালো।
এছাড়াও বরিশালের 'বলেশ্বর নদী' থেকে দুইটি ধারা প্রবাহিত হয়েছে। এক ধারার পানি
লোনা ও বিস্বাদ এবং
অন্য ধারার পানি মিষ্ট ও সুস্বাদু। বিষয়টি
আমাদের সাধারণ মনে হলেও সমুদ্রবিজ্ঞানীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও আশ্চর্যজনক। পৃথিবীতে
আল্লাহর কুদরতি নিদর্শনাবলির অন্ত নেই। পাহাড়-পর্বত, আকাশ-জমিন, নদ-নদী, চন্দ্র-সূর্য, তরুলতা ও পাখ-পাখালি
সবই আল্লাহর কুদরতের সৃষ্টি। এগুলোর সৃষ্টি মানুষের কল্যাণার্থে। পাশাপাশি এতে উপদেশও নিহিত আছে। জ্ঞানীরা এসব দেখে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে। ঈমান মজবুত করে।
শুধু নদী
বা সমুদ্রই নয় ভুগর্ভেও বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন স্বাদের পানির প্রবাহ বিদ্যমান যা পবিত্র
কুরআনের উক্ত বক্তব্যের সমার্থক বলে বিভিন্ন
তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংগৃহীত ও পরিমার্জিত