বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

দৈত্যাকার তিমি


ফ্যামিলি ট্যুরে সেন্টমার্টিন যাচ্ছিলাম কেয়ারী সিন্দাবাদে চেপে। একেবারে বুড়ো থেকে থেকে শুরু করে চার মাসের বাচ্চা পর্যন্ত আছে। পয়তাল্লিশ জনের বিশাল লটবহর। এসব ভ্রমনে যতটা মজা হয় তার চাইতে বেশি কাজ করতে হয়। টিকেট কাট, সব্বাইকে তোল, সবার সব ব্যাগ উঠছে কিনা দেখ, আর মেয়ে মানুষ থাকলে তো কথাই নেই একজনের জন্য তিনটা করে ব্যাগ। জাহাজ ছাড়লো বিশমিনিট হলো। আমি সবকিছু চেক করছি। হঠাৎ দেখি ধুপধাপ শুরু হলো। গলা বাড়িয়ে দেখি ভাগ্নে আয়ান আর আফনান মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে দু’টার কান ধরে আমার কেবিনে নিয়ে আসলাম। ওরা দুই জমজ ভাই। মারামারি করতে সময় লাগে না আবার মিলে যেতেও সময় লাগেনা। সমস্যা খুবই সামান্য। একজন তিমি মাছ দেখার জন্য ডেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যজন বলেছে বঙ্গোপসাগরে তিমি থাকে না। ব্যাস কথা কাটাকাটি মারামারি। দুই ভাগ্নেকে নিয়ে তিমি মাছ নিয়ে গল্প শুরু করলাম। 

তোমরা তো তিমিকে মাছ বলো প্রথম কথা হলো তিমি মাছই না। এরা সামুদ্রিক প্রানী ঠিক আছে কিন্তু তারা স্তন্যপায়ী। আমরা যেমন ছোট বেলায় মায়ের দুধ খেয়ে বড় হই, তিমিরাও তেমন। তিমি হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রানী। তিমির মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি আছে তারমধ্যে নীল তিমি সবচেয়ে বড়। এরা লম্বায় ২৫ থেকে ৩২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। মানে ৮২ ফুট থেকে ১০৫ ফুট। একেকটা তিমির গড় ওজন ১৪০ টন যা ২৫ টি হাতীর ওজনের সমান। নীল তিমি আসলে নীল নয়, এর রঙ ফ্যাকাসে টাইপের। কিন্তু তারা যখন সাগরের পানির নিচে থাকে তখন তাদের দেখতে নীল মনে হয়। তিমির বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী নীল তিমি, খুনে তিমি (killer whale), এবং পাইলট তিমি। বাচ্চা তিমি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০ পাউন্ড করে বাড়ে।

তিমির শ্বাস গ্রহনঃ
তিমি সমুদ্রে থাকে অথচ পানি থেকে নিশ্বাস নিতে পারেনা। তিমি স্তন্যপায়ী প্রাণী। পানিতে বসবাস হলেও এরা মানুষের মতোই বাতাসে শ্বাস নেয়। এজন্য কিছুক্ষণ পর পর এদের পানির উপর ভেসে উঠতে হয়। সুতরাং এরা যদি পানির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তো তারা দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তাহলে এখন প্রশ্ন, এরা তাহলে ঘুমায় কখন? তিমির শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য রয়েছে বিশেষ এক ব্যবস্থা। মানুষের যেমন প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাস নিতে হয়, তিমির কিন্তু সেরকম নয়। এরা কম করে হলেও ৩০ মিনিট পর্যন্ত দম না নিয়ে থাকতে পারে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়, অর্থাৎ আমি চাই বা না চাই ফুসফুস নিজের মতো স্বাধীনতাভাবে কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু তিমির শ্বাস-প্রশ্বাস স্বয়ংক্রিয় নয়, সেটা তাদের সচেতন সিদ্ধান্তের বিষয় হওয়ায় তিমি যদি ঘুমিয়ে পড়ে এবং সময়মতো না জাগে, তাহলে দম আটকে মারাও যেতে পারে। এই বিপদের সমাধান হিসেবে তিমির মস্তিষ্কের অর্ধেক কিছুক্ষণ ঘুমায়, বাকি অর্ধেক ঘুমায় পরের পালায়। তাদের অন্তত অর্ধেক মস্তিষ্ক সবসময় জেগে থাকে, তাই তারা শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঘুমের মধ্যেও প্রয়োজনীয় সময়ে ভেসে ওঠে। মাঝে-মধ্যে তিমি মাছকে পানির প্রায় উপরিতলে হালকাভাবে নিস্তেজ অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখা যায়। এটাই তাদের ঘুমন্ত অবস্থা। তিমি মাছের ঘুমের এ বিষয়টি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফির (ইইজি) মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে তিমির মাথায় তার লাগিয়ে মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এভাবে প্রাপ্ত ইইজির ফলাফলে দেখা গেছে ঘুমের সময় তিমি মাছের অর্ধেক মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। বলা যায়, আমরা যেমন কখনো কখনো আধা ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে থাকি, তিমির ঘুমও সেরকম। তিমি যখন নিঃশ্বাস ছাড়ে তখন সে তার মাথার উপর দুই ছিদ্র দিয়ে পানি ফোয়ারার মত করে ছুঁড়ে দেয় যা ত্রিশ ফুট পর্যন্ত উপরে উঠে। 

তিমির খাদ্যঃ 
না না ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, তিমি মানুষ খায় না। এদের মুখে দাঁতই নেই। দাঁতের বদলে আছে ব্যালিন। ব্যালিন অনেকটা ঝালরের মত উপরের চোয়াল থেকে নিচের দিকে ঝুলে থাকে। একেকটা ব্যালিন ৫০ সেঃ মিঃ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর কামড়ানোর বা চিবানোর জন্য দাঁতের প্রয়োজন হয়না। কারণ তিমির খাবার ক্ষুদ্র এক প্রানী নাম ক্রীল। ক্রীল চিংড়ীর মত একপ্রকার সামুদ্রিক পতঙ্গ। এটি লম্বায় সাধারণত আমাদের হাতের ছোট আঙ্গুলের মত হয়ে থাকে। এর রঙ ফ্যাকাসে গোলাপী। উত্তর ও দক্ষিন মেরু অঞ্চলের ঠান্ডা সাগরে কোটি কোটি ক্রীল বসবাস করে। তিমির মত বিশাল প্রানী যদি একটা একটা করে ক্রীল খায় তবে তিমির পেট কোনদিনই ভরবে না। তিমি একসাথে লোনা পানিসহ একঝাঁক ক্রীল মুখে টেনে নেয়। তিমির গলার কাছে চামড়ায় প্রায় ৮৮ টি ভাঁজ থাকে। তিমি যখন মুখ হাঁ করে তখন তার সব ভাঁজ খুলে এক বৃহদকার বেলুনে পরিণত হয়। তারপর সব পানি ব্যলিনের মধ্য দিয়ে ছেড়ে দেয়। এটা অনেকটা ছাঁকনির মত কাজ করে। ব্যালিনের কারণে মুখের মধ্যে ক্রীলগুলো আটকে যায়। ক্রীলগুলো জমা হলেই সে গিলে ফেলে। একটি তিমি দিনে প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন ক্রীল খায়। যা রাখার জন্য তিনটি বড় ট্রাকের প্রয়োজন হয়।

তিমির পানিতে ভেসে থাকাঃ 
তোমরা নিশ্চয়ই আরব্য রজনীর সিন্দাবাদের গল্প শুনে থাকবে। সিন্দাবাদের গল্পে সিন্দাবাদ একবার সমুদ্রের মাঝে দ্বীপ খুঁজে পেয়েছিলো। সেখানে সে তার নৌকা থামায়। দ্বীপে কোন বড় গাছ না থাকলেও লতা-পাতা ও ঘাস ছিল। সে এবং তার বাহিনী সেখানে বিশ্রাম নেয়। কিছুক্ষন পর তারা রান্নাবান্নার আয়োজন করে। আগুন জ্বালানোর কিছু সময়পর দ্বীপটা নড়ে উঠে। তারপর হুট করেই তলিয়ে যায়। তখন সবাই বুঝতে পারে এটা আসলে কোন দ্বীপ ছিলনা। এটি ছিল একটি বড় আকারের তিমি। অনেকদিন ধরে ভেসে থাকার কারণে বালি জমে পিঠের উপর মোটা আস্তরন পড়ে গিয়েছে। সেখানে নানা ধরণের লতাপাতাও জন্মেছে। যদিও এটা গল্প তবে একেবারে ভিত্তিহীন না। তিমি শীতকালে কিছু খেতে পারেনা। কারণ শীতকালে মেরু অঞ্চলের পানি বরফে পরিণত হয়। ফলে ক্রীলগুলো বরফের নিচে চলে যায়। তিমি আর তাদের নাগাল পায়না। এই সময় ররফশীতল পানি আর ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে উষ্ণ সাগরের দিকে যেতে থাকে। তাই শরতকালেই তারা তাদের ভ্রমণ শুরু করে।প্রায় দুইমাস ধরে তাদের ভ্রমন চলতে থাকে। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল দক্ষিণ মেরুতে তখন গ্রীষ্মকাল। তাই তিমিরা বিষুবরেখার কাছাকাছি আসলেই উষ্ণ সাগর পেয়ে যায়। আবার দক্ষিণ মেরুতে যখন শীতকাল তখন উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মকাল। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ মেরুর তিমিরাও বিষুব রেখার কাছাকাছি এসে উষ্ণ পানির দেখা পায়। দুই মেরুর তিমিগুলো বিষুব রেখার কাছাকাছি আসলেও তাদের পরষ্পরের মধ্যে কখনোই দেখা হয়না কারণ বছরের দুই সময়ে দুই মেরুর তিমি বিষুব রেখার কাছে আসে। এই সময় তিমিরা খুব কম খায়। মূলত গ্রীষ্মকালে খাওয়ার কারণে তাদের শরীরে মোটা চর্বির আস্তরণ পড়ে। তা থেকেই তাদের পুষ্টির যোগান হয়। এই সময়টা তারা সাগরে অলস ভাবে ভেসে থাকে যতদিন না তাদের বাসস্থানে শীতকাল শেষ না হচ্ছে। আগেই বলেছি তিমি বাতাস থেকে শ্বাস গ্রহন করে। তাই সে গভীর সমুদ্রে থাকতে পারে। আধো জাগরণ আধো ঘুম নিয়ে সে ভেসে থাকে সমুদ্রে। এমনই কোন তিমিকেই হয়তো পেয়েছিল সিন্দাবাদ। আবার শীতকাল শেষ হলে তারা মেরু সাগরে ফিরে আসে। 

তিমির গান গাওয়া
আরে! অবাক হচ্ছো! অবাক হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ্‌র এই দুনিয়ায় কত রকম বিচিত্র প্রানী সৃষ্টি করেছেন তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। তিমিরা পরষ্পরের সাথে এক ধরণের সুরেলা শব্দ করে যোগাযোগ করে, যা তিমির গান নামে পরিচিত। তিমির বিশালতা ও শক্তিমত্ততার মতোই এদের গানও অনেক জোরালো। হাম্পব্যাক নামে এক প্রাজাতির তিমি আছে, যারা তাদের সুরেলা গানের জন্য সুপরিচিত। স্পার্ম তিমির গান মৃদু গুঞ্জনের মতো শোনায়। তাদের এই গান যা বহু মাইল দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়। তিমি ১৬৩ ডেসিবেল শব্দ তীব্রতায় ২০,০০০ একুস্টিক ওয়াটে শব্দ তৈরি করে।

২টি মন্তব্য: