বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

ট্রান্সফরমারের টুকিটাকি



মাঝে মাঝে ঝড়-বৃষ্টিতে বাজ পড়ার মত শব্দ করে পাওয়ার কাট হয় আর সবাই বলে উঠে ট্রান্সফরমার ফুটে গেছে। আমাদের শহরে অবশ্য ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে যাওয়া বা ফিউজ কেটে যাওয়া বড় কোন সমস্যা না। তবে গ্রামে যারা থাকে তারা জানে ট্রান্সফরমার নষ্ট হওয়া কত বিড়ম্বনার। মাঝে মাঝে ঠিক করতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে যায়। তোমরা কি জানো ট্রান্সফরমার কী এবং এর কাজই বা কী? যারা জানো তারা তো জানোই আর যারা জানোনা তোমাদের জন্যই আজকের এই লিখা। আজ আমরা জানবো ট্রান্সফরমারের সব খুঁটিনাটি। 

একসময় AC বলে কিছু ছিল না সবই ছিল DC বা ডিরেক্ট কারেন্ট। ডিরেক্ট কারেন্টের সমস্যা ছিল এটা বহুদূর পর্যন্ত পরিবহন করা যায় না। পরিবহনে কারেন্ট লস হতো খুব বেশী। ইলেকট্রিসিটি যখন তারের মধ্য দিয়ে যায়, তখন আস্তে আস্তে তার পাওয়ার লস হতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভাষায় একে বলা হয় লাইন লস। এই লাইন লস P=I2R সূত্র মেনে চলে।
P মানে পাওয়ার,I মানে কারেন্ট আর R মানে রেজিস্ট্যান্স বা বাধা।
তার মানে, যে পরিমাণ কারেন্ট ফ্লো করবে, তার বর্গাকারে লাইন লস হবে। কারেন্ট ফ্লো যদি দুই গুণ বাড়ে, লাইন লস বাড়বে চার গুণ। কারেন্ট ফ্লো তিনগুণ বাড়লে লাইন লস নয়গুণ। এডিসন জানতেন, কোনভাবে যদি কারেন্টের ফ্লো-টা কমানো যায়- তাহলেই কাজ হবে। লাইন লস কমে যাবে। সেই সাথে দূরে বহুদূরে ইলেকট্রিসিটিও পাঠানো যাবে। এই সমস্যার সমাধান হয় ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে। তবে DC তে এর সমাধান হয়নি। এর জন্য উদ্ভাবিত হয় AC বা অল্টারনেটিং কারেন্ট। 

নিকোলা টেসলা। তিনি ঘূর্নায়মান চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর কাজ করতে গিয়ে এসি কারেন্টের দেখা পান। সাথে সাথে তিনি এসি কারেন্ট কি করে উৎপাদন, সরবরাহ এবং ব্যবহার করা যায় - সেটার উপরেও কাজ করেন। ইলেকট্রিসিটির একটা বেসিক সূত্র হচ্ছে,
P=VI, যেখানে P মানে পাওয়ার, V মানে ভোল্টেজ, আর Iমানে কারেন্ট। 

টেসলা ভেবে দেখলেন, কোনভাবে ভোল্টেজ বাড়িয়ে দিয়ে, আর কারেন্ট কমিয়ে দিতে পারলে একই পাওয়ার বহুদূর পৌঁছাতে পারবেন। ব্যাপারটা তোমাদের একটু খুলে বলি। ধরো তুমি পাঠাতে চাচ্ছো ৫০০ ওয়াট। তো তুমি যদি ৫০ ভোল্ট উৎপন্ন কর, তাহলে তোমাকে পাঠাতে হবে ১০ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট। কারণ, ৫০X১০=৫০০। ১০ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট মানে কিন্তু অনেক কারেন্ট। লাইন লস হবে অনেক। এখন তুমি যদি কারেন্ট কমিয়ে ১ এ্যাম্পিয়ার করতে চাও, তাহলে তোমাকে উৎপন্ন করতে হবে ৫০০ ভোল্ট। কারণ, ৫০০X১=৫০০। তুমি একই পাওয়ার পাঠাচ্ছ অথচ লাইন লস কমে যাচ্ছে বহুগুণ। কিন্তু ভোল্টেজ চেঞ্জটা করবে কে?

ট্রান্সফর্মার এই কাজটা করে। টেসলা দেখলেন, কাছাকাছি দুটো কয়েল রেখে একটা কয়েলে এসি ভোল্টেজ দিলে সেটা “ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশনে”র মাধ্যমে অন্য কয়েলে ভোল্টেজ “ইনডিউস” করে। এটা ফ্যারাডে’র সূত্র অনুসারে হয়। টেসলা গবেষণা করে দেখলেন এই ব্যাপারটা ডিসিতে কাজ করেনা। সংজ্ঞাকারে যদি বলতে চাই তাহলে এভাবে বলা যায়, ট্রান্সফরমার এমন একটি বৈদ্যুতিক ডিভাইস যার সাহায্যে পাওয়ার ও ফ্রিকুয়েন্সি পরিবর্তন না করে কোন প্রকার বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়া শুধুমাত্র চুম্বকীয়ভাবে সংযুক্ত দুইটি কয়েলে প্রয়োজন অনুযায়ী ভোল্টেজ কমিয়ে বা বাড়িয়ে এক সার্কিট থেকে অন্য সার্কিটে পাওয়ার স্থানান্তর করা যায়। 
চিত্রে দুটি কয়েল একটি অভিন্ন ল্যমিনেটেড কোরের সাথে চম্বুকীয়ভাবে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে এসি উৎসের সাথে সংযুক্ত কয়েলকে প্রাইমারী কয়েল এবং লোডের সাথে সংযুক্ত কয়েলকে সেকেন্ডারী কয়েল বলা হয়। প্রাইমারী কয়েল এসি উৎসের সাথে সংযুক্ত করলেই ইলেক্ট্রোম্যগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি হয় যা পার্শ্ববর্তী সেকেন্ডারী কয়েলকে আবেশিত করে। তখন সেকেন্ডারী কয়েলে ভোল্টেজ ইনডিউস হয়। এভাবে প্রাইমারী কয়েল থেকে সেকেন্ডারী কয়েলে পাওয়ার ট্রান্সফার হয়। প্রাইমারী কয়েল থেকে সেকেন্ডারী কয়েলে পাওয়ার ট্রান্সফার হলে ভোল্টেজের মান সেকেন্ডারীতে বাড়বে নাকি কমবে অথবা কারেন্টের মান কমবে না বাড়বে এই বিষয়টা নির্ভর করে সেকেন্ডারী কয়েলের পাক সংখ্যার উপরে। সেকেন্ডারী কয়েলের পাক সংখ্যা যদি প্রাইমারী কয়েলের পাক সংখ্যার চাইতে বেশী হয় তাহলে সেকেন্ডারী কয়েলে ভোল্টেজের মান বেড়ে যাবে এবং কারেন্টের পরিমাণ কমে যাবে। এই ধরনের ট্রান্সফরমারকে স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার বলা হয়। আর উল্টো ঘটনা ঘটলে বলা স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমার। 

ধরি একটি ট্রান্সফরমারের প্রাইমারী কয়েলে পাক সংখ্যা ১৫০, সেকেন্ডারী কয়েলের পাক সংখ্যা ৯০০। প্রাইমারী কয়েলে যুক্ত করা হয়েছে ৩০০ ভোল্ট এবং ৩ এম্পিয়ারের এসি। তাহলে সেকেন্ডারী কয়েলে ভোল্টেজের মান ও কারেন্টের মান কেমন হবে? আমরা ট্রান্সফরমারের সুত্রে সাহায্যে খুব সহজে তা বের করতে পারি। 

আমরা মোটামুটি ট্রান্সফরমারের থিওরি বুঝে নিয়েছি। আসো এবার আমরা ট্রান্সফরমার কী কী নিয়ে গঠিত হয় তা নিয়ে জানার চেষ্টা করি। 

উইন্ডিং (Winding): ট্রান্সফরমারের উইন্ডিংয়ে দুই বা ততোধিক কয়েল থাকতে পারে। এই কয়েল সমূহ সাধারণত সুপার এনামেল তামার তারের হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট আকৃতির ফরমায় তৈরী কয়েলসমূহ একটি কোরের উপর বসানো হয়। প্রাইমারী উইন্ডিং এবং সেকেন্ডারী উইন্ডিংয়ের প্যাঁচের সংখ্যা ও সাইজ সমান হয় না। কারণ এই প্যাঁচের মাধ্যমেই আমরা কাংখিত ভোল্টেজ ও কারেন্ট পেয়ে থাকি। 

কোর (Core): উইন্ডিংগুলো যে ইস্পাতের ফ্রেমের উপর জড়ানো থাকে তাকেই কোর বলা হয়। ইস্পাতের কোর ব্যবহারের ফলে প্রাইমারীতে উৎপন্ন ম্যাগনেটিক ফ্লাক্স অনায়াসে সেকেন্ডারীর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে। কোর ব্যবহারের ফলে কোর লসের উদ্ভব হয়। কোর লস হচ্ছে এডি কারেন্ট (eddy current) লস এবং হিস্টেরিসিস লসের যোগফল। ইস্পাতের কোরকে ভালোভাবে স্তরায়িত করে এডি কারেন্ট লস কমানো যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটা কোরের পুরুত্ব ৫০ সাইকেল ফ্রিকোয়েন্সির জন্য ০.৩৫ মিমি এবং ২৫ সাইকেল ফ্রিকোয়েন্সির জন্য ০.৫ মিমি হয়ে থাকে। ভালো ইস্পাত ব্যবহারের মাধ্যমে হিস্টেরিসিস লসও কমানো যায়। এক্ষেত্রে শতকরা চার ভাগ সিলিকন মিশ্রণ ব্যবহারে ইস্পাতের permeability বৃদ্ধি পায়। 

ইন্সুলেশন (Insulation): কয়েলের নিজেদের প্যাঁচের মধ্যে ইন্সুলেশন সুপার এনামেল আবরণের দ্বারাই হয়ে থাকে। তাছাড়া কয়েল তৈরীর সময় কিছু প্যাঁচ পর পর অ্যাম্পিয়াল ক্লথ বা লেদার ওয়েব পেপারও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোরকে কয়েল হতে ইন্সুলেট করার জন্য কোরের উপর ইন্সুলেটিং পেপার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বড় বড় ট্রান্সফরমারের ক্ষেত্রে কোর ও কয়েলকে ইন্সুলেটিং তেলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে ইন্সুলেটিং শক্তি ব্যবহার করা হয়। 

ট্যাংক (Tank): উইন্ডিংস এবং ট্রান্সফরমার কোর একটি ট্যাংকের মধ্যে তেলে ডুবানো থাকে। ইস্পাত দিয়ে ওয়েল্ডিং করে ট্যাংকটি তৈরী করা হয়। ট্যাংকের উপর জলবায়ু নিরোধক গ্যাসকেট লাগিয়ে তার উপর ঢাকনা দিয়ে লাগানো হয়। কোরকে শক্ত করে ট্যাংকের তলার সঙ্গে আটকানো হয়। 

ট্রান্সফরমার ওয়েল (Transformer Oil): ট্যংকের মধ্যে যে তেল ভর্তি করা থাকে তাকেই ট্রান্সফরমার অয়েল বলা হয়। এটি মূলত ইন্সুলেটিং অয়েল। এর মূল কাজ ইন্সুলেশন এবং উইন্ডিংকে ঠান্ডা রাখা। 

কনজারভেটর (Conservator): ট্রান্সফরমার তেল গরম হলে আয়তনে বাড়ে এবং ঠান্ডা হলে আয়তনে কমে যায়। বাড়া-কমার এই সমস্যা সমাধানের জন্য ট্যাংকের উপর একটি ড্রাম বসানো থাকে। এই ড্রামটিকে কনজারভেটর বলা হয়। এটি একটি পাইপের মধ্য দিয়ে ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত থাকে। তেল গরম হয় আয়তনে বাড়লে পাইপের মধ্য দিয়ে কিছু তেল কনজারভেটরে চলে আসতে পারে। আবার তেল ঠান্ডা হয়ে সংকুচিত হলে কনজারভেটর থেকে কিছু তেল ট্যাংকে চলে নেমে আসে। 

ব্রীদার (Breather): ট্যাংকে জলীয় বাষ্পমুক্ত শুষ্ক বাতাস প্রবেশ করানোর জন্য যে পাত্র ব্যবহার করা হয় তাকে ব্রীদার বলে। এটা একটা কাঁচের পাত্র। তেল বাড়া কমার সাথে বাতাস আসা যাওয়ার জন্য কনজারভেটরের উপরের দিকে একটি পাইপ দিয়ে ব্রীদার যুক্ত করা থাকে। ব্রীদারের মধ্য সিলিকা জেল নামে এক প্রকার রাসায়নিক থাকে। সিলিকা জেলের মূল কাজ হলো ব্রীদারের মধ্য দিয়ে বাতাস আসা যাওয়ার সময় তা জলীয় বাষ্প শুষে নেয়। 

বুশিং (Bushing): উইন্ডিং এর টার্মিনালগুলো বুশিং এর মাধ্যমে ট্রান্সফরমার ট্যাংকের বাইরে আনা হয়। এই বুশিং এর মাধ্যমে প্রাইমারী কয়েল ac উৎসের সাথে এবং সেকেন্ডারী কয়েল লোডের সাথে সংযুক্ত হয়। বুশিং দুই ধরনের হয় হাই সাইড বুশিং এবং লো সাইড বুশিং। হাই সাইড বুশিং এর আকার বড় হয় এবং লো সাইড বুশিং এর আকার ছোট হয়। তোমরা তো জানই ট্রান্সফরমারে মূল কাজ ভোল্টেজ মান পরিবর্তন করা। তাই প্রাইমারী ও সেকেন্ডারীতে ভোল্টেজের মান সমান থাকে না। ভোল্টেজের মানের সাথে সংগতি রেখেই পরিবহন তার যুক্ত করা হয়। নইলে দূর্ঘটনা ঘটবে। সে জন্যই হাই সাইড বুশিং ও লো সাইড বুশিং এর প্রয়োজন হয়। উচ্চ ভোল্টেজের উইন্ডিং হাই সাইডের সাথে অন্যটা লো সাইডের সাথে যুক্ত হবে। 

বুখোলজ রীলে (Buchholz relay): এই রীলেটি ট্রান্সফরমার ট্যাংক কনজারভেটরের সংযোগকারী পাইপের মধ্যে লাগানো থাকে। ট্রান্সফরমারে কোন কারণে গ্যাস জমলে যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া তেলের গুণাগুণ নষ্ট হলেও এই রীলে সংকেত দেয়। 

আর্থ পয়েন্ট (Earth Point): ট্রান্সফরমারের বডি গ্রাউন্ডিং করার জন্য দুইটি আর্থ পয়েন্ট থাকে। ঐ দুটি পয়েন্ট মাটির সাথে সংযুক্ত থাকে। এটি নানান দূর্ঘটনা থেকে ট্রান্সফরমারকে রক্ষা করে এমনকি বজ্রপাতের সময়ও ট্রান্সফরমারকে সেইভ করে। 

থার্মোমিটার(Thermometer): ট্রান্সফরমার তেলের তাপমাত্রা মাপার জন্য একটি থার্মোমিটার বা টেম্পারেচার মাপার যন্ত্র থাকে। এর পরিমাপকারী দন্ডটি ট্রান্সফরমারের ভেতরে একটি তেলভর্তি প্যাকেটের সাথে সংযুক্ত থাকে। 

এখানে একটি থ্রী পেজ ট্রান্সফরমারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যেগুলো আমরা সচরাচর রাস্তায় দেখি। এছাড়াও বহু ধরণের ছোট বড় ট্রান্সফরমার রয়েছে।

৪টি মন্তব্য: