সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মেঘ বৃষ্টির খেলা



মেঘ কি?
মেঘ বলতে পৃথিবীর বা অন্য কোন গ্রহের আবহাওয়া মন্ডলে ভাসমান জলকণার সমষ্টি বোঝানো হয়। সাধারণত পানি পৃথিবীতে কোথাও স্থির অবস্থায় থাকেনা, বিভিন্ন মাধ্যমে আবর্তিত হচ্ছে এবং অবস্থার পরিপর্তন হচ্ছে। আমরা সাধারন ভাবে পানির কঠিন, তরল, বায়ুবীয় তিন অবস্থায় দেখে থাকি। বায়বীয় অবস্থারই একটি রূপ হল মেঘ। পানির সবচেয়ে বড় ও স্থায়ী উৎস হল সমুদ্র, এ ছাড়াও রয়েছে নদী নালা খাল বিল। সূর্যের তাপে বাষ্পীয়ভবনের মাধ্যমে এসব উৎস থেকে পানি হালকা হয়ে বাষ্পাকারে উপরে ওঠে এবং এই বাষ্প ঠান্ডা ও ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় ভাসমান মেঘ।


মেঘ থেকে বৃষ্টি
প্রথমে ভুপৃষ্ঠ থেকে জলীয়বাষ্প যতই উপরে উঠতে থাকে ততই ঠান্ডা ও ঘনীভূত হতে থাকে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০০০ ফুট উঁচু থেকে ঘনীভূত হতে শুরু হয়। এই ঘনীভূত মেঘ অনেকটা ঘন কুয়াশার মত। এই কুয়াশামন্ডলী প্রচন্ড বাতাসের কারণে হিমায়িত অঞ্চলে পৌঁছালে আরো ঠান্ডা হয়ে পানির কণায় পরিণত হয়। নিচ থেকে উষ্ণ বাতাসের সাথে ধূলিকণা উপরে আসলে এই ধূলিকণাকে কেন্দ্র করে পানি জমতে থাকে। এক পর্যায়ে পানির কণা পাঁচ সেঃমিঃর বড় হলে তা মধ্যাকর্ষনের টানে বৃষ্টি হয়ে ভূমিতে পড়ে। এই বৃষ্টি ফোঁটার আকৃতি অনেক সময় ছোট-বড় হতে পারে। বৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বিশেষ ভুমিকা রাখে। উপরের শীতল বায়ু যেমন বাষ্পকে ঠান্ডা করে মেঘে পরিণত করে, তেমনি নিচের উষ্ণ বায়ু মেঘ থেকে বৃষ্টি নামতে ভূমিকা রাখে।

শিলা বৃষ্টি
অনেক সময় পানির কণা অতিরিক্ত ঠান্ডা হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফকনায় পরিণত হয়। এই বরফকণা হিমায়িত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠের দিকে আসার সময় চারদিকের হিমায়িত ঘণীভূত কুয়াশার কারণে বরফ কণার আয়তন বেড়ে যায়। গড়ে একটি শিলার ব্যাস ৫ থেকে ১৫০ মিলিমিটার হতে পারে। সাধারণত পুঞ্জ বর্ষণ( ঈঁসঁষড়হরসনঁং পষড়ঁফং') মেঘ শিলাবৃষ্টির জন্য দায়ী।

ঝড়ো আর সংকটপূর্ণ আবহাওয়াতে যখন শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ উপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন শিলা তৈরী হয়। উষ্ণ বায়ু উপরের দিকে উঠতে থাকে, আর শীতল বায়ু নিচের দিকে নামতে থাকে। যখন সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ হিমায়িত পানির উৎস তৈরি হয় তখন মেঘে বরফ জমতে থাকে ঐ শীতল পানির দানা এবং শীতল বায়ুর সংমিশ্রণে ।

ঊর্ধ্বমুখী বায়ু এমন একটা অবস্থানে পৌঁছায় যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে চলে যায় এবং পানি বরফ হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুতে সৃষ্ট বরফ খন্ড ঐ বায়ুপ্রবাহ থেকে ছুটে গিয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এই ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর উপরে উঠে যাওয়ার পরে বরফকণা সৃষ্টি হয়ে নিম্নগামী হওয়ার প্রক্রিয়া বারবার চলতে থাকে। বরফকণার উপর আস্তরণ জমা হয়ে তা বরফ খন্ডের আকারে রূপ নেয়। এই ঊর্ধ্বমুখী বাতাসের কিন্তু বেশ ভালোই গতি থাকতে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই গতি ৬০ মাইল/ঘন্টা ও হতে পারে।

যখন শিলা ঊর্ধ্বাকাশ থেকে পতিত হতে থাকে, তখন এটি পতনশীল অবস্থায় কিছুটা গলে যায়, আর এমন তাপমাত্রায় এটা গলে যার কারণে এটা আবার ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর সাথে উপরে উঠে যায়। সুতরাং, এর থেকেই বুঝা যায় যে খুব বড় আকারের শিলাখন্ড আসলে অনেকবারের পুনঃপ্রক্রিয়ার ফসল।

এই শিলা খন্ডগুলো বৃষ্টির পানির কণা বা মেঘকে আশ্রয় করে এবং যখন এগুলো ক্রমশঃ ভারী হয়ে উঠে এবং ঊর্ধ্বগামী বায়ু আর এতটা ভারীকণা বহন করতে পারে না, তখন শিলাখন্ড বৃষ্টির সাথে ভূমিতে পতিত হতে থাকে। যাকে আমরা শিলাবৃষ্টি হিসেবে দেখতে পাই।

মেঘেদের আচরণ ও বৈশিষ্টগত দিক দিয়ে দুটি শ্রেনীতে ভাগ করা হয়: স্তরীভূত ও পরিচলনশীল। মূলত মেঘকে তার পাদদেশের উচ্চতা দিয়ে শ্রেণীবিভাগ করা হয়, চূড়ার উচ্চতা দিয়ে নয়। এই পদ্ধতি ১৮০২ সালে লিউক আস্কেসিয়ান সোসাইটিতে প্রস্তাব করেন।

মেঘের শ্রেনীবিভাগ আচরণগত দিক দিয়ে স্তরীভূত ও পরিচলনশীল দুই ভাগে ভাগ করা হলেও উচ্চতার দিক দিয়ে উঁচু, মধ্যম ও নিচু তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

এসব মেঘ সাধারনত ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ ফুট হয়ে থাকে। এই বিশাল উচ্চতার কারনে সূর্যের আলো মেঘ ভেদ করে পৃথিবীতে আসতে না পারার কারণে মেঘকে কালো দেখায়।

বিভিন্ন প্রকার মেঘ
১. অলক মেঘ (Cirrus clouds) : এ সকল মেঘ দেখতে বরফ স্ফটিকের পাখনার মত। মেঘের উপরে অনেক উচ্চতায় এরা গঠিত হয়। এদের কতক পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দশ মাইলের মত উচ্চতায় গঠিত হয়ে থাকে।



২. আনুভূমিক মেঘ (Stratus clouds) : সাধারণত এ ধরণের মেঘ মাটি থেকে মাত্র কয়েক'শ ফুট উপরে গঠিত হয়। এরা হালকা-পাতলা কুয়াশার মত। ভোরবেলা কিংবা সন্ধ্যায় যখন বাতাস স্থির থাকে, তখন এ ধরনের মেঘ দেখা যায়।

৩.পুঞ্জ মেঘ (Cumulus clouds) : এগুলো দেখতে সুন্দর পুঞ্জিভূত মেঘ। এই ধরনের মেঘকে ছায়া মেঘ বলা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে এরা আকাশে দেখা যায়।


পৃথিবী থেকে মাত্র এক মাইল উপরেও থাকে এবং মাটিতে দ্রুত ধাবমান ছায়া ফেলে। মধ্য বিকেলে সূর্য যখন সর্বাধিক উষ্ণ থাকে, তখন এরা আকার ও সংখ্যায় বেড়ে যায় এবং এদের শীর্ষদেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত উচ্চতায় উঠে যায়। সন্ধ্যাবেলা এরা আনুভূমিক মেঘের স্তরে মিশে অদৃশ্য হয়ে যায়।

৪. জলধ মেঘ (Nimbus clouds) : এগুলো হচ্ছে ঘণ ধূসর বর্ণের বর্ষণ মেঘ। এদের গঠন-প্রকৃতি আকারবিহীন। বর্ষণ মেঘের নিচের দিকে অর্ধাংশ থাকে জলকণায় ভারী যা কখনও কখনও বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হয়ে নিচে পতিত হয়। উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের মেঘকে আবার সংযুক্ত আকারেও দেখা যায়।


৫. উচ্চপুঞ্জ মেঘ (Auto-cumulus clouds) গোলাকার, মহাতরঙ্গময়, সাদা কিংবা ধূসরাভ। এগুলো ছােট ছোট মেঘপুঞ্জের ঘন সন্নিবিষ্ট রূপ। আট থেকে বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় এদের দেখা যায়।



৬ উচ্চ আনুভুমিক মেঘ (Alto-stratus clouds) দেখতে পুরু, ধুসর নীলাভ পাতের ন্যায় মাটি থেকে সাড়ে ছয় হাজার থেকে বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থান করে ।





৭. ঘন অনুভূমিক মেঘ (Cirro-stratus) বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বরফ স্ফটিকে গঠিত এক প্রকার পাতলা সাদা পাতের মত মেঘ।


৮. অলকাপুঞ্জ মেঘ (Cirro-cumulus) হচ্ছে ঘন মেঘমালার ভিতর গঠিত এক টুকরা মেঘ যা দেখতে সাগরতীরস্থ বালুকারাশির ঢেউয়ের মত। বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় এই মেঘ গঠিত হয়।



৯.পুঞ্জ বর্ষণ মেঘ(Cumulonimbus clouds ) এই মেঘকে বজ্র মস্তক বলা হয়। এরা অনেকটা দেখতে ফুলকপির মত। এই ধরনের মেঘ বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে উপর পর্যন্ত দেখা যায়।



১০. আনুভূমিক পুঞ্জ (Strato-cumulus) মেঘ হচ্ছে সেই সব বিন্দু বিন্দু মেঘ যা পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে শুরু করে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তার হয়ে থাকে।

1 টি মন্তব্য: