বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

বৈদ্যুতিক মাছ



নাম শুনে অবাক হয় তাসফিয়া।
- ইলেকট্রিক ঈল! সেটা আবার কিভাবে? মাছ কিভাবে ইলেকট্রিক হয়?
- হয় হয়। এটা শক্তিশালী ইলেকট্রিক মাছ। মাছটা দেখতে বাইন মাছের মত।
- এটা কি বিদ্যুৎ তৈরী করে?
- আরে হ্যাঁ এ জন্যই তো একে বৈদ্যুতিক মাছ বলা হয়। এরা ৬০০ ভোল্ট ক্ষমতা সম্পন্ন শক দিতে পারে।
- তাহলে তো আমরা মরেই যাবো!
- অবশ্যই। তবে তারা খুব অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ তৈরী করে বিধায় মরে না গেলেও বড় ক্ষতি হবে। এটা একটা ঘোড়াকেও কয়েক মুহুর্তের জন্য বিদ্যুতায়িত করে ফেলতে পারে।
- ওরে বাবা। কি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর প্রাণি আছে সমুদ্রে।
- আমরা কি এই মাছের বিদ্যুৎ দিয়ে আলো জ্বালাতে পারবো?
- না, সেটা করা যাবে না কারণ এদের চার্জ খুব অল্প সময়ের জন্য আসে আবার মুহুর্তের মধ্যে চলে যায়। তবে নিয়ন লাইট জ্বলতে পারে কারণ নিয়ন লাইটের জন্য খুব অল্প সময়ের চার্জ হলেই হয়।
- চাচ্চু এরকম প্রশ্নোত্তর করে বললে কিছুই বুঝতে পারবো না। তুমি বরং শুরু থেকেই বল।
- তাহলে আয়ান-আফনান সবাইকে ডাক। একসাথে গল্প করবো।

ইলেকট্রিক মাছ:
যেসব মাছ ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করতে পারে তাদের বলা হয় ইলেক্ট্রোজেনিক। আর যেসব মাছ ইলেকট্রিক ফিল্ডের উপস্থিতি টের পায় এবং এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে তাদের ইলেক্ট্রোরিসেপটিভ বলা হয়। বেশিরভাগ ইলেক্ট্রোজেনিক মাছই ইলেক্ট্রোরিসেপটিভ, আর এরাই হলো ইলেকট্রিক মাছ। ইলেকট্রিক মাছ সম্পর্কে জানার আগে চলো ইলেকট্রিক ফিল্ডটা একটু জেনে নিই।


বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কোন কণা যেখানে অবস্থান করে সেখানে তার চারদিকে যতদূর পর্যন্ত তার বলের প্রভাব বিস্তৃত থাকে, সেই অঞ্চলকে বলা হয় ইলেকট্রিক ফিল্ড। এই বল আকর্ষনধর্মী বা বিকর্ষনধর্মী হতে পারে। একই রকম চার্জ হলে বিকর্ষন আর বিপরীতধর্মী চার্জ হলে আকর্ষন হয়। এটি একটি ভেক্টর রাশি। ইলেকট্রিক ফিল্ডের এই ধারণাটি সবার আগে দেন মাইকেল ফ্যারাডে। একটি ইলেকট্রিক ফিল্ড বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কণার জন্য হতে পারে অথবা সময়ের সাথে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের জন্যও হতে পারে। তবে ইলেকট্রিক মাছ চার্জিত কণার মাধ্যমেই ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করে।

বিভিন্ন ধরণের মাছ ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করতে পারে। এর মধ্যে ইলেকট্রিক ঈল সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করতে পারে। সব ইলেকট্রিক মাছই তাদের লেজের দিকে থাকা কিছু স্পেশাল অঙ্গ দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন করে। একে বলা হয় ‘ইলেকট্রিক অর্গান’।
- আচ্ছা চাচ্চু যখন কোন মাছ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে তখন তারা নিজেরা সে বিদ্যুতে শক খায় না?
- না, এই ধরনের মাছদের ইলেকট্রিক অর্গান বা বৈদ্যুতিক অঙ্গের চারপাশে ইন্সুলেটর অন্তরক থাকে। অন্তরকের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয় না বিধায় তারা শক খায় না।


যা বলছিলাম, ইলেকট্রিক অর্গানে থাকে বৈদ্যুতিক উত্তেজনা গ্রহনে সক্ষম কোষ যাদের বলা হয় ইলেক্ট্রোসাইটস। এই ইলেক্ট্রোসাইটস মস্তিষ্কের নির্দেশ অনুসারে কাজ করে। সকল প্রানীরই সকল কার্যক্রমের নির্দেশ আসে ব্রেইন থেকে। অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে না। এই ক্ষমতা কেবল ব্রেইনের। আর অন্যান্য অঙ্গগুলো ব্রেইনের নির্দেশ পালন করে। যেমন ধরো তোমার বাম হাতে একটা মশা বসেছে। প্রথমে ত্বক এই খবর ব্রেইনকে জানাবে। ব্রেইন এরপর চোখকে নির্দেশ দিবে দেখে অবস্থান নির্ণয় করার জন্য। এরপর ডানহাতকে নির্দেশ দিবে মশাটিকে আঘাত করার জন্য। এই পুরো ঘটনাই ঘটে এক মূহুর্তের মধ্যে। আর এই নির্দেশ পরিবহন করে স্নায়ুতন্ত্র। ইলেকট্রিক মাছের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যখন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা মনে করে ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি করা দরকার তখন তারা তাদের ব্রেইন থেকে সিগন্যাল বা নির্দেশ স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে পাঠায় ইলেক্ট্রোসাইটসগুলোর কাছে। একে ফায়ারিং বলা হয়। ফায়ারিং হওয়ার মুহুর্তের মধ্যে ইলেক্ট্রোসাইটসগুলো নিজেদেরকে ব্যাটারির মত সমবর্তিত আকারে সাজিয়ে নেয় যেভাবে আমরা টর্চলাইট জ্বালানোর জন্য ব্যাটারিগুলো সাজিয়ে নিই। আর তাতেই ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী হয়। এরপর ইলেকট্রিক অর্গান ডিসচার্জের (EODs) মাধ্যমে আশপাশের পানিতে নির্গত হয়।

ইলেকট্রিক অর্গান ডিসচার্জ (EODs)
ইলেকট্রিক মাছের যে অঙ্গ শরীরের চারপাশে ত্রিমাত্রিক ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করে তাকেই ইলেকট্রিক অর্গান ডিসচার্জ (EODs) বলা হয়। (EODs) দুই রকমের হয়। পালস টাইপ এবং ওয়েব টাইপ। যেসব মাছ শক্তিশালী ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে তাদের সবার (EODs) পালস টাইপ। আর যেসব মাছ দূর্বল ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে তাদের মধ্যে কিছু মাছেরও পালস টাইপ (EODs) থাকে। পালস টাইপ মানেই হলো তারা DC ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। অন্যান্য মাছ যারা দূর্বল ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে তাদের (EODs) ওয়েব টাইপ মানে তারা AC ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে।
DC মানে Direct Current। যে ভোল্টেজ বা কারেন্ট এর মান সব সময় স্থির থাকে এবং কোন একটি মাত্র নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয় (সময়ের সাথে এর দিক পরিবর্তীত হয় না), সে ভোল্টেজ বা কারেন্টকে ডিসি ভোল্টেজ বা ডিসি কারেন্ট বলে। ডিসি ভোল্টেজ বা কারেন্টের উৎস হল: ব্যাটারী, সৌরকোষ ইত্যাদি। আর অপরদিকে AC মানে Alternating Current। অর্থাৎ যে ভোল্টেজ বা কারেন্টের মান ও দিক সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তীত হয় তাকে এ.সি. কারেন্ট বা ভোল্টেজ বলে। এরকম উৎস হল: AC জেনারেটর/ অল্টারনেটর। আরো সহজ করে বলতে গেলে ডিসি কারেন্ট সোজা সাপ্টা। নিরবিচ্ছিন্ন তার প্রবাহ, সময়ের সাথে এর মানের পরিবর্তন হয় না। টর্চ লাইটে পাঁচ ভোল্টের ব্যাটারী যে বিদ্যুৎ দিয়ে থাকে তা হল ডিসি কারেন্ট। অন্যদিকে এসি কারেন্ট এর উল্টো। সময়ের সাথে বাড়ে কমে। বাসা বাড়ীতে ট্রান্সমিশন লাইন দিয়ে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তা হচ্ছে এসি কারেন্ট। নীচের ছবিতে ডিসি ও এসি কারেন্ট।



ইলেক্ট্রোরিসেপ্টরঃ
আগেই তোমাদের বলেছি সব ইলেকট্রিক মাছ কিন্তু ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করতে পারেনা। তবে ইলেকট্রিক মাছই ইলেকট্রিক অনুভব করতে পারে। এই অনুভূতি তারা পায় একটি সেন্সেটিভ সেন্সরি অর্গানের মাধ্যমে। এই সেন্সরি অঙ্গটি ইলেকট্রিক মাছের ত্বকের সাথে সংযুক্ত থাকে। ইলেক্ট্রোরিসেপ্টর মূলত ব্যবহৃত হয় মাছের দেহের আশপাশের কোন বস্তু সনাক্ত করতে। এর মাধ্যমে তারা রাতের অন্ধকারে এবং ঘোলা পানিতে কোন বস্তু সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘একটিভ ইলেক্ট্রোলোকেশন’। ইলেক্ট্রোজেনেরিক এবং ইলেক্ট্রোরিসেপ্টিভ সক্ষমতা থাকার কারণে ইলেকট্রিক মাছগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে ইলেকট্রিক সিগন্যালের মাধ্যমে। একে ইলেক্ট্রোকমিউনিকেশন বলা হয়।

পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ প্রজাতির ইলেকট্রিক মাছ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ গুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
১- ইলেকট্রিক ঈলঃ এটি ইলেকট্রিক মাছ হিসেবে খুব বিখ্যাত। এটি দেখতে বাইন মাছের মত। লম্বায় ২.৫ মিটার এবং ওজনে প্রায় ২০ কিলোগ্রামের মত হয়ে থাকে। এটি দুই ধরণের (EODs) এর মাধ্যমে ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী করে। লো-ভোল্টেজ EODsএর মাধ্যমে প্রায় ১০ ভোল্ট এবং ২৫ হার্জের ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। এই লো-ভোল্টেজ EODs এর মাধ্যমে ইলেকট্রিক ঈল ইলেক্ট্রোলোকেশন এবং ইলেক্ট্রোকমিউনিকেশনের কাজ করে। হাই-ভোল্টেজ EODs এর মাধ্যমে ৫০০ ভোল্টের এবং ৫০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১ অ্যম্পিয়ার ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। যার দ্বারা অনায়াসে একটি ঘোড়াকে হত্যা করা সম্ভব।

২- ইলেকট্রিক রেঃ বিভিন্ন প্রজাতির ইলেকট্রিক রেইস দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো লম্বায় ৫ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বড় মাছগুলো প্রায় ৯০ কিলোগ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এই মাছগুলো ৮ ভোল্ট থেকে শুরু করে ২২০ ভোল্ট পর্যন্ত ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন করতে পারে। এগুলো মজার বৈশিষ্ট্য হলো এরা টিস্যুর মধ্যে ইলেক্ট্রিসিটি জমা রাখতে পারে অনেকটা ব্যাটারির মত।

৩- ইলেকট্রিক ক্যাটফিসঃ এটিও শক্তিশালী ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করতে পারে। এই মাছগুলো লম্বায় ৪ ফুট এবং ওজনে প্রায় ২০ কিলোগ্রামের মত হয়ে থাকে। তারা প্রায় ৩৫০ ভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করতে পারে, যা একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

৪- এলিফ্যান্ট নোজ মাছঃ এরা সর্বোচ্চ এক মিটারের মত লম্বা হয়। তবে বেশীরভাগ প্রজাতিই তিরিশ সেমি এর মত হয়। এই মাছগুলো দূর্বল ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। এরা সাধারণত ইলেক্ট্রোলোকেশনের কাজে তাদের ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে যেখানে সাধারণত অন্ধকার থাকে বা ঘোলা জল থাকে। নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন করার জন্যও তারা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে।

৫- ছুরি মাছঃ এরা সাধারণত লম্বায় ১৬৮ সেমি বা ৬৬ ইঞ্চি হয় এবং ওজনে প্রায় ২০ কিলোগ্রামের মত হয়ে থাকে। এই মাছগুলো ১০০ ভোল্টের মত ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। এই মাছগুলোও দূর্বল ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে। এলিফ্যান্ট ফিসের মত এরাও ইলেক্ট্রোলোকেশন, কমিউনিকেশনে এরা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে।

এছাড়াও হাঙ্গর, রে, স্কেইট, ক্যাটফিস, পেডল ফিস ইত্যাদি মাছের মধ্যে অনেক প্রজাতি রয়েছে যারা ইলেক্ট্রোরিসেপ্টিভ। এছাড়াও প্লাটিপাস যদিও মাছ নয় তারপরও তারা ইলেক্ট্রোরিসেপ্টিভ।

নয়েজ পরিহার করার প্রক্রিয়াঃ
তোমরা রেডিও স্টেশনের কথা জান, আলাদা আলাদা স্টেশন আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। আচ্ছা একটু ভাবো তো, যদি সব রেডিও স্টেশন একই ফ্রিকোয়েন্সিতে সম্প্রচার করতো তাহলে কি হত?
-সব তো গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলতো। আয়ানের জবাব।
- হ্যাঁ সেটাই। ইলেকট্রিক মাছের ক্ষেত্রেও সেই সমস্যাটা হয়।

যেসব মাছ ওয়েব টাইপ ইলেক্ট্রিসিটি তৈরী করে তারা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে ইলেক্ট্রিসিটি নির্গত করে। যখন একই সাথে একই স্থানে দু’টো ইলেকট্রিক মাছ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে ইলেক্ট্রিসিটি নির্গত করে তখন নয়েজের সৃষ্টি হয়। এই নয়েজের ফলে তারা ইলেক্ট্রোলোকেশনে সমস্যা হয়। যখনই মাছগুলো বুঝতে পারে সমস্যা হচ্ছে তখন তারা নিজেদের ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে নেই যতক্ষন না সমস্যা দূর হচ্ছে।

1 টি মন্তব্য: