বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

বর্ণচোরা অক্টোপাস


তোমাদের নিশ্চয় মনে আছে অক্টোপাস পলের কথা। বুদ্ধিমান ঐ অক্টোপাসটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতার জোরে ভবিষ্যত ইঙ্গিত করতে পারতো। মজার বিষয় কি জানো! সামুদ্রিক প্রানীদের মধ্যে অক্টোপাস সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট। তারা ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী দু’ধরনের স্মৃতিই ধারণ করে রাখতে পারে। এমনকি তারা জলের ভেতর গোলকধাঁধা থেকেও বের হয়ে আসতে পারে একুইরিয়াম থেকে বের হওয়ার মতো করে। তারা তাদের ইচ্ছেমত শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। বর্ণিল হয়ে মিশে যেতে পারে সমুদ্রের তলদেশের পাহাড়ের সাথে অথবা জলজ উদ্ভিদের সাথে। অক্টোপাস অনেক সময় দুষ্টুমি করে জেলেদের নৌকা আটকে দেয়। এমনকি তারা কাঁকড়া ঝিনুকের খোলস ছাড়িয়ে তাদের মাংস খেয়ে পেটভর্তি করতে পারে। বিভিন্ন পাত্র/মগ এর ঢাকনা খোলার ব্যবস্থাও এই প্রাণীটির জানা আছে।

দৈহিক গঠনঃ
তোমরা যারা মাধ্যমিকে পড় তারা তো শ্রেনীবিন্যাসের কথা জানো। প্রাণিরাজ্যের অন্তর্গত মোলাস্কা পর্বের অক্টোপাস গণের প্রজাতিসমূহের সাধারণ নাম। এই গণের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৩০০।এই প্রজাতিগুলির দেহের আয়তন ছোটো বলের আকার থেকে বৃহদাকার তরমুজের মতে হয়ে থাকে। এদের মস্তিষ্ক বেশ সুগঠিত। দেহ থেকে আটটি সর্পিলাকার শুঁড় নির্গত হয়েছে। এগুলোর সাহায্যে অক্টোপাস চলাচল, খাদ্যগ্রহণ, আত্মরক্ষা প্রভৃতি করে থাকে। প্রজাতিভেদে শুঁড়গুলি সাধারণত দৈর্ঘ্যে তিন থেকে দশ হাত পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়। এগুলির নিচের দিকে দুই সারিতে অনেকগুলি গোলাকৃতির শোষক থাকে, শিকার ধরার প্রাথমিক পর্যায়ে শোষকগুলিকে শত্রুকে কাবু করার জন্য ব্যবহার করে। এরা মাংসাশী প্রাণী হলেও অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির।

Kingdom (রাজ্য) : Animalia
Phylum (পর্ব) : Mollusca
Class (শ্রেণী) : Cephalopoda 
Subclass (উপ-শ্রেণী) : Coleoidea
Superorder ((উর্ধ্ব-বর্গ) : Octopodiformes
Order (বর্গ) : Octopoda
Suborder (উপবর্গ) : Incirrina, Cirrina
Family (গোত্র) : Octopodidae
Genus (গণ) : Octopus

খাদ্যঃ
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা আবার বেশ রসিক। মাছ-গোশত ছাড়া অন্য কিছু মুখেই রোচে না। সমুদ্রের অগভীর জলে পাহাড়ের গায়ে বসবাস করে আর মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও বিভিন্ন প্রকার ছোট সামুদ্রিক প্রাণীকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।

চলাচলঃ
প্রজাতিভেদে এদের চলাচলের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের দেখা যায়। তবে চলাচলের ক্ষেত্রে দুটো প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই বৈশিষ্ট্য দুটো হলো, সমুদ্রতলে পায়ে হেঁটে চলন পদ্ধতি ও পানিতে মুক্তভাবে সাঁতার কেটে চলার পদ্ধতি। কোথাও দ্রুত যাওয়ার প্রয়োজন হলে এরা পানিতে মুক্তভাবে সাঁতার কাটে। আর কাছে পিঠে যাতায়াত বা স্বাভাবিক যাতায়াতের জন্য শুঁড় ব্যবহার করে হেঁটে চলাচল করে। 

আত্মরক্ষাঃ
আগেই বলেছি অক্টোপাস বুদ্ধিমান প্রানী। এদের আত্নরক্ষার কৌশল বেশ মজার। এরা সেনাবাহিনীর মত কামোফ্লাজ করে। সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার সময় যে বিশেষ ধরনের রং ও ডিজাইনের উর্দি পরে, সেটার কাজ হলো সৈন্যদের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মিলিয়ে অদৃশ্য করে দেয়া। অক্টোপাসও ইচ্ছেমত নিজের দেহের রঙ পরিবর্তন এবং মাথার নিচের নলাকার ফানেল জলপূর্ণ করে দ্রুতবেগে বের করে দিয়ে তাড়াতাড়ি দূরে সরে যেতে পারে। রং পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রতলের বালি, পাথর, উদ্ভিদ ইত্যাদির সাথে এমনভাবে মিশে যেতে পারে যে হাঙ্গর, ইল, ফিন (অক্টোপাসের প্রধান শত্রু) খুব কাছ থেকেও একে সনাক্ত করতে পারে না। এছাড়াও এদের দেহে কালি থলে (ink sac) থাকে যার সাহায্যে অক্টোপাস নিজের দেহ থেকে ঘন কালো কালি ছুঁড়ে দিয়ে পুরো এলাকা অন্ধকার করে দেয়। ব্যাস, অন্ধকার থাকতে থাকতেই সে পালিয়ে যায়। তখন তাকে খঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। এই কালির আরেকটি গুণ হচ্ছে এটি শত্রুর ঘ্রাণশক্তিও কিছুক্ষণের জন্য নষ্ট করে দেয়। এতে তার নিরাপত্তা আরো জোরদার হয়। অক্টোপাস খুব দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে, এটিও আত্নরক্ষায় সহায়ক।

দৈত্য অক্টোপাসঃ
সাধারণ অক্টোপাস ভয় পাওয়ার মত না হলেও এই জায়ান্ট অক্টোপাস কিন্তু ভয়ে দাঁত আটকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৈত্যাকার অক্টোপাস নামে পরিচিত। হাঙ্গর দেখে এরা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা। বাগে পেলে দুই চারটা হাঙ্গর ওরা পেটে চালান করে দেয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Enteroctopus dofleini। এই অক্টোপাস ১০০ পাউন্ড (৪৫ কেজি) থেকে শুরু করে ৪৫০ পাউন্ড (প্রায় ২০০ কেজি) পর্যন্ত হতে পারে। এই প্রজাতির স্ত্রী-অক্টোপাসের প্রতি বাহুতে প্রায় ২৮০টি চোষক থাকে। সব মিলিয়ে সকল বাহুতে প্রায় ২২৪০ টি চোষক দেখা যায়। তবে পুরুষ অক্টোপাসের বাহুতে ১০০টির বেশি চোষক দেখা যায় না। এই অক্টোপাসগুলো উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ জাপানের উপকুল বরাবর প্রায় ৭৫০ মিটার নিচের সাগর তলে এদের দেখা যায়। 

বিষাক্ত অক্টোপাসঃ 
কিছু কিছু অক্টোপাস বিষযুক্ত। এরা শিকার কাবু করার জন্য এবং শত্রু মোকাবেলার জন্য বিষ ছুঁড়ে দেয়। এগুলো ব্লু রিংড অক্টোপাস নামে পরিচিত। এই অক্টোপাস খুব ছোট মাত্র ৫ থেকে ৮ ইঞ্চি এবং দেখতেও চমৎকার। এর সারা শরীর উজ্জ্বল নীলাভ ফ্লোরসেন্ট বাতির মতো রিং থাকে। এটি বিপদ দেখলে খুব দ্রুত রঙ পরিবর্তন করে নীলাভ রিং সহ উজ্জ্বল হলুদ বর্ণে পরিণীত হয়। এটি এতই সুন্দর যে, মনে হয় ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির একুরিয়ামে রেখে দিই। কিন্তু, সমস্যা হলো এর বিষ তোমাকে বিনা পয়সায় পরলোক যাত্রার ব্যবস্থা করে দিবে, যার কোন প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত নেই।
বংশবৃদ্ধিঃ
স্ত্রী-অক্টোপাস প্রজননকালে ২০,০০০ থেকে ১০০,০০০ ডিম পাড়ে। এবং স্ত্রী-অক্টোপাস ৫ থেকে ৭ মাস ধরে ডিমগুলির পাহারা দেয় ও যত্ন নেয়। এরপর ডিম ফুটে তিন মিলিমিটার আকৃতির শিশু অক্টোপাস বেরিয়ে আসে। এদের জীবনকাল মোটামুটি ৫ থেকে ৮ বৎ্সর। স্ত্রী-অক্টোপাসের ৫ থেকে ৭ মাসের অধিক সময় ধরে ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে শিশু অক্টোপাস বেরিয়ে আসে। এই শিশু অক্টোপাসগুলো সাগরের উপরের প্লাঙ্কটনের ভিতরে ভেসে বেড়ায়। তিমির প্লাঙ্কটন আহারের সময় বেশিরভাগ শিশু অক্টোপাস ধ্বংস হয়ে যায়। যেগুলি রক্ষা পায়, তারা ৪-১২ সপ্তাহ প্লাঙ্কটনের ভিতরে থাকার পর, ধীরে ধীরে সাগরতলে নেমে আসে।

অক্টোপাসের মাঃ
প্রাণিজগতে যদি “ওয়ার্ল্ডস বেস্ট মম” এর কোনো খেতাব চালু থাকতো, তাহলে সেটা অবশ্যই “মা অক্টোপাস” পেত। এর কারণ, মা অক্টোপাস যখন টানা ৭ মাস ধরে ডিমে তা দেয়, ঐ সময় তারা কিছু খায়না। এতটা সময় ধরে ডিম ছেড়ে কোথাও যায়না। আর সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেশিরভাগ মা অক্টোপাস। 

এমন একটি বেস্ট মায়ের সন্ধান পায় বিজ্ঞানীদল। সমুদ্রের তলদেশে জীবদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে মধ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রে একটি রিমোট নিয়ন্ত্রিত সাবমেরিন পাঠিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সে সময় তারা একটি নারী অক্টোপাসের সন্ধান পান, যেটা সমুদ্র তলদেশের অন্তত ৪,৬০০ ফিট নীচে একটি পাথরের খাঁজে অবস্থান করছিল। 

সেখানে স্বচ্ছ ও আলোকিত ১৬০টি ডিমও দেখতে পান বিজ্ঞানীরা।ডিমগুলো প্রথম অবস্থায় একগুচ্ছ কালো জামের মতো ছিল, পরে ধীরে ধীরে সেগুলো একগুচ্ছ আঙুরের মতো দেখতে হয়। এই দীর্ঘ সাড়ে চার বছরে মা অক্টোপাসকে কখনো তার স্থান থেকে নড়তে দেখা যায়নি। এমনকি পুরো সময়টা সে না খেয়েই থেকেছে। এ দীর্ঘ সময়ে না খাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে মা অক্টোপাসটি শুকিয়ে যায় এবং বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। ২০০৭ সালের মে মাস থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবিরাম অক্টোপাসটির ওপর সাবমেরিনের সাহায্যে নজর রেখেছিলেন বিজ্ঞানীরা। 

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন