সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭

জেনারেটর আবিষ্কারের গল্প

১৭৯১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডে নিউইংটন বাটস অঞ্চলে কামার পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় ফ্যারাড। চার ভাইবোনের মধ্যে ফ্যারাড ছিলেন তৃতীয়।

বাবা জেমস ছিলেন একজন কামার। আর্থিক অনটনের মধ্যেই ফ্যারাড বড় হতে থাকেন। বাড়ির কাছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার পড়ালেখা শুরু হয়। ফ্যারাডের উচ্চারণে সমস্যা ছিলো। তিনি “র” উচ্চারণ করতে পারতেন না। এটা নিয়ে সবখানে হাসাহাসি হতো, এমনকি স্কুলেও। সামান্য যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ শেখা পর্যন্তই ছিলো তার গণিতের দৌড়! তারপর অর্থের অভাবে মাঝপথেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। এরপর আর কোনদিন স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার।


মাত্র ১৩ বছর বয়সে, স্কুল ছেড়ে কাজ নেন একটি বইয়ের দোকানে। সেখান থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। এরপর কাজ নেন বই বাঁধাইয়ের দোকানে। কাজের ফাঁকে অবসর পেলেই বসতেন বই নিয়ে । বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো তাকে বেশি আকর্ষণ করত। কিছুদিনের মধ্যে তিনি তার বাড়িতে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ছোট একটা ল্যাব তৈরি করে ফেলেন। হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে গবেষণার জন্য একটা দুটো করে জিনিস কিনতেন। আবার ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে অনেক পুরোনো জিনিস সংরক্ষন করতেন।

২১ বছর বয়সে একদিন হঠাৎ করে তিনি স্যার হামফ্রের সাথে কাজ করার সুযোগ পেলেন। হামফ্রে তাকে ল্যাবরেটরির বোতল ধোয়ার কাজ দিলেন। কাজের ফাঁকেই তিনি হামফ্রের গবেষণা মনযোগ সহকারে দেখতেন। দেখা, শেখা আর নিজের প্রচেষ্টা। এর পথ ধরে তিনি মানব জাতির উন্নয়নে রাখেন মহা মূল্যবান অবদান।

তার যুগান্তকারী আবিস্কারের মধ্যে চৌম্বকের সাথে তড়িতের সম্পর্ক। এর মাধ্যমেই শক্তির এক বিশাল রূপান্তর মানবজাতির হাতে আসে।

এই আধুনিক যুগে ইলেকট্রিসিটি ছাড়া আমাদের এক মূহুর্তও চলা অসম্ভব। কিন্তু তোমরা কি জানো, এই তড়িৎ কিভাবে, কোথা থেকে উৎপন্ন হয়? আর কাদের হাত ধরেইবা এই অতি মুল্যবান শক্তি আমাদের সেবায় নিয়োজিত।



১৭৩৩ সালে ডাচ বিজ্ঞানী পিটার ভ্যান স্থির তড়িৎ ধরে রাখার জন্য লেডেনজার নামে এক প্রকার যন্ত্র তৈরি করেন। ১৭৪৮ সলে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০) পিটার ভ্যানের কয়েকটা লেডেনজার সেল একত্র করে তৈরি করেন তড়িৎ ধারক বা ব্যাটারি। তিনি এই ব্যাটারিকে চার্জ করার জন্য এক প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করেন। সেটাই ছিল সম্ভবত প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র । যাকে জেনারেটরের আদিরূপ বলা যেতে পারে। যদিও জেনারেটরের সাথে এর কোন মিল নেই।

তড়িৎ এবং চুম্বকত্বের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে স্থির বৈদ্যুতিক নীতির উপর ভিত্তি করেই জেনারেটর নির্মিত হত। ব্রিটিশ উদ্ভাবক জেমস উইমহার্স্ট এমন একটি স্থির বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম উইমহার্স্ট যন্ত্র।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে স্যার হামফ্রে ডেভির ল্যাবে কাজ করার সময় ফ্যারাড লক্ষ্য করেন একটা তারের কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বককে আনা-নেওয়া করলে ভোল্টেজ উৎপন্ন হয়।



এই আবিষ্কারকে ফ্যারাডের তড়িচ্চৌম্বক নীতি বলা হয়। এই নীতির উপর ভিত্তি করে ফ্যারাডেই প্রথম তড়িচ্চৌম্বক জেনারেটর তৈরি করেন যা চল তড়িৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। তার জেনারেটর বা ডায়নামোটিকে "ফ্যারাডে ডিস্ক" বলা হয়। অশ্বক্ষুরাকৃতির একটি চুম্বকের দুই মেরুর মাঝখানে স্থাপিত কপার চাকতির ঘূর্ণন ব্যবহার করে এই যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে পরবাহীকে ঘুরালে ইলেকট্রনের প্রবাহ হয়। আর ইলেট্রন প্রবাহই যে তড়িৎ তা তোমরা অনেকেই জান। কোন পরমানুর শেষ কক্ষ্য পথের ইলেকট্রন প্রবাহ হলেই তা তড়িতে রুপ নেয়।

জেনারেটর কী?

জেনারেটর আমরা কমবেশি সবাই চিনি।। জেনারেটর একটি ইংরেজি শব্দ। যার অর্থ- কোন কিছু উৎপন্ন করা বা জেনারেট করা। কিন্তু কী উৎপন্ন করা? পাওয়ার বা শক্তি উৎপন্ন করা। অর্থাৎ আমরা যদি কোন জেনারেটর চালুকরি তাহলে সেটি থেকে নির্দিষ্ট পরিমানের ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি উৎপন্ন হবে। যেহেতু এখানে মেকানিক্যাল পাওয়ারকে ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ারে রূপান্তর করা হচ্ছে সেহেতু এটিকে আমরা রূপান্তরকও বলতে পারি।



জেনারেটরের গঠন



জেনারেটরে মুলত দুটি মৌলিক অংশ থাকে। যে অংশ চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে তাকে বলা হয় ম্যাগনেটিক সার্কিট। স্থির থাকে বলে একে স্টেটও বলা হয়। আর যে অংশ তড়িৎ উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত সেটার নাম ইলেকট্রিক সার্কিট। এটা ঘুরন্ত বলে একে রোটর বলা হয়।









জেনারেটরের মুল কাঠামো কে ফ্রেম বা মুল বডি বলা হয়। যা জেনারেটরের বহিরাবরণ। এর মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে খাঁজ কাটা থাকে। এই খাঁজের মধ্যে কৃত্রিম চৌম্বক তৈরির জন্য পরিবাহী বসানো থাকে। এই পরিবাহীতে বাইরে থেকে তড়িৎ সরবরাহ করে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিকে এক্সাইটেসন বলা হয়। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুকে পরস্পর লম্বভাবে আকর্ষণ করে। 

একে লাইন অফ ফোর্স বলা হয়।পরিবাহীকে এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ঘুরানোর ফলে লাইন অফ ফোর্স পরিবাহী দ্বারা কর্তন হয়। এবং ভোল্টেজ ইৎপন্ন হয়। 



খুব ছোট মোটর বা জেনারেটরের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চুম্বক ব্যবহার করা হয়। সাধারন ৬ ভোল্ট এর উপরের মোটর বা জেনারেটরের জন্য কৃত্রিম চৌম্বক ব্যবহার করা হয়।






চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে পরিবাহীকে একটি রোটরের মধ্যে বসানো হয়। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ঘুড়ানোর জন্য বাহিরে থেকে যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ কার হয়। এই যান্ত্রিক শক্তিকে প্রিমুভার বলা হয়। ঘর্ষণজনিত বাধা এখানে যান্ত্রিক শক্তির অপচয়ের মুল কারন। রোটরকে বাধাহীন ভাবে ঘোরানো এবং ঘর্ষণ বাধা কমানোর জন্য দুই পাশে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।








জেনারেটর কিভাবে কাজ করে?



প্রইমুভার দিয়ে যখন রোটর কে ঘুরানো হয়,তখন ফ্যারাডের তড়িচ্চৌম্বক নীতি অনুসারে রোটর জড়ানো পরিবাহীতে বিভব (voltage)পার্থক্য দেয়। আমরা তো জানি বিভব পার্থক্য হলেই তড়িৎ প্রবাহ বা ইলেকট্রনের প্রবাহ হয়। মজার ব্যাপার হল যে অংশকে ঘুড়ানো হয়,তড়িৎ উৎপন্ন হয় সেই অংশেই।




উৎপন্ন তডিৎকে এক প্রকার ব্রাশের মাধ্যমে ঘুরন্ত অংশের বাহিরে আনা হয়। প্রইমুভার দিয়ে কয়েল যত বেশি জোড়ে ঘোড়ানো যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন তত বেশী হবে।

সবসময় যে চৌম্বক ক্ষেত্রই স্থির থাকবে তা নয়। হাই ভোল্টেজ উৎপাদনের সময় ঘুরন্ত পরিবাহী থেকে তড়িৎ বাহিরের সার্কিটে আনা ভীষণ ঝুকিপুর্ণ হয়ে দাড়ায়। এ কারনে পরিবাহীকে স্থির রেখে চৌম্বক ক্ষেত্রকে ঘুড়ানো হয়। এই মেশিনকে জেনারেটর না বলে অল্টারনেটর বলা হয়।



জেনারেটরে সাধারণত এসি তড়িৎ উৎপন্ন হয়। নানা সুবিধার জন্য একে ডিসি বিদ্যুতে রূপান্তর করে ব্যবহার করা হয়। তাপ এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা, এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্টারনাল এক্সহাস্ট ফ্যান ব্যবহার করা হয়।

জেনারেটর আর মোটরের মৌলিক গঠনগত কোন পার্থক্য নেই। জেনারেটরে মেকানিক্যাল শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রুপান্তর করে। আর মোটর বৈদ্যুতিক শক্তিকে মেকানিক্যাল শক্তিতে রূপান্তর করে।

ছোট পরিসরের জন্য জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। আর বানিজ্যিকভাবে তড়িৎ উৎপাদনের জন্য অল্টানেটর ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে মুলত অল্টারনেটর ব্যবহার করা হয়।

বন্ধুরা একটু হলেও তোমরা শক্তির এই বিশাল রূপানাতরক সম্পর্কে জানলে। আশা করি জানার আগ্রহ তোমাদের আরো জ্ঞান অর্যনে সাহায্য করবে।



বন্ধুরা আজ এ পর্যন্তই ভাল থেকো আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ ।
লেখাটি কিশোর বিজ্ঞান ম্যাগাজিন ব্যাপনে প্রকাশিত হয়েছে


0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন