বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

ভূমিকম্পের কম্পন


কি এক বিদঘুটে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এখন সবার মাঝে। কিছু একটা নড়লেই মনে হয় এই বুঝি ভূমিকম্প হলো, পড়ি কি মরি করে সবার সে কি ছোটাছুটি। নেপালের ভূমিকম্পের ভয়াবহতা আমাদের মনে বেশ আতংক ধরিয়ে দিয়েছে। একদিকে ভূমিকম্পের ভয় অন্যদিকে ভাগ্নে আয়ানের প্রশ্নের পর প্রশ্ন আমার জীবন একেবারে নয়ছয় করে দিয়েছে। ভূমিকম্প কেন হয়? কে ধাক্কা দেয়? মাটির নিচে কি দৈত্য আছে? কেন সে ধাক্কা দেয়? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন আয়ানের।

এসব প্রশ্ন কমবেশী আমাদের সবার মনেই ঘুরপাক খায়। এসো বন্ধুরা আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো ভূমিকম্প কি? কেন হয়? কিভাবে হয়? হলে পরে আমাদের কি করা উচিত? ইত্যাদি। মজার বিষয় কি জানো? আমরা সারাক্ষন ভুমিকম্পের উপরেই আছি। প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষবার ভূমিকম্প হয়। সে হিসেবে দিনে প্রায় ১৩৭০ বার। ঘন্টায় ৫৭ বার। তার মানে প্রায় প্রতি মিনিটেই ভূমিকম্প হচ্ছে। ভাগ্য ভালো এর বেশীরভাগই আমরা টের পাইনা। কারণ সেগুলো খুব কম মাত্রার কম্পন হয়ে থাকে। আর বেশীরভাগ কম্পন সমুদ্রের তলদেশে হয়ে থাকে। তাই আমাদের টের পাওয়ার কথাও না।

কেন সমুদ্রের তলদেশে বেশী হয়? এটার অবশ্য আলাদা কোন কারণ নেই। পৃথিবীর তিনভাগ সমুদ্র আর মাত্র একভাগ স্থল। তাই অনুপাত হিসেবে সমুদ্রেই বেশী ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্রায় ৭০ ভাগ কম্পনই হয়ে থাকে সমুদ্রে। মোটের উপর আমরা টের পাই শুধু ১ শতাংশ ভূমিকম্প। তার মানে বছরে প্রায় পাঁচ হাজারটি ভূমিকম্প আমরা টের পাই। এখন তোমরা হয়তো প্রশ্ন করে বসবে- এতগুলো ভূমিকম্প কোথায় হয়েছে? আমরা তো জানি চার-পাঁচটা। বড় জোর দশ বারোটা। আসলে বেশীরভাগ ভূমিকম্পেই তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়না। অল্প কয়টা মারাত্মক কম্পনেই বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর তাতেই এটা নিয়ে বেশী আলোচনা হয় এবং আমরাও জানতে পারি ভূমিকম্প হয়েছে। আসো মূল আলোচনায় যাই।

ভূমিকম্প কি?
ভূমিকম্প হল ভূমির কম্পন। সহজ কথায় বলতে গেলে পৃথিবী পৃষ্ঠের কাঁপাকাঁপিই ভূমিকম্প। পৃথিবীর পৃষ্ঠের কিছু কিছু অংশ প্রাকৃতিক নিয়মে মাটির নিচে সৃষ্ট আলোড়নের ফলে কেঁপে উঠে। আর এই কম্পনকেই আমরা ভূমিকম্প বলে থাকি। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে- প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে গভীর ভূমিকম্প বলে।

ভূমিকম্প কেন হয় এই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসো আমরা ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট কিছু শব্দ আর সেগুলোর মানে জেনে নিই।

টেকটনিক প্লেটঃ 
তোমরা তো জানই আমাদের পৃথিবী বর্তুলাকার বা ডিম্বাকার। আমরা উপরের ভূপৃষ্টে বসবাস করি। ডিমের খোলসের মত এটা খুবই শক্ত এবং ঠান্ডা। কিন্তু পৃথিবীর ভেতরে কি আছে? পৃথিবীর যে কাঠামো রয়েছে তার তিনটি অংশ। সিলিকন ও অক্সিজেনের যৌগ সিলিকেটের তৈরী বহির্ভাগের লবণাক্ত ও কঠিন ভূত্বক, যার পুরুত্ব প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার। এর নিচেই আছে প্রায় দুই হাজার নয়শ কিলোমিটার পুরু এক ধরণের ঘন ও আঠালো অংশ। আর একদম কেন্দ্রে আছে উত্তপ্ত গলিত লাভা। যার ব্যাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। ২য় অংশ মানে ঘন ও আঠালো অংশের একদম উপরিভাগ সাতটি গুরুত্বপুর্ণ অংশে বিভক্ত। এই অংশগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। অঞ্চল ভিত্তিক সাতটি টেকটেনিক প্লেট হলো আফ্রিকান, অস্ট্রেলীয়, ইউরেশীয়, ভারতীয়, উত্তর আমেরিকান, দক্ষিণ আমেরিকান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয়। সাতটি মূল প্লেট হলেও বড় টেকটনিক প্লেট আছে ১৫ টি। আর ছোট ছোট প্লেট আছে অনেক। এগুলো পনেরটি বড় প্লেটের মধ্যেই অবস্থিত।

চিত্রঃ টেকটনিক প্লেট ও ফল্ট লাইন

ফল্ট লাইনঃ
আমরা তো টেকটনিক প্লেট সম্পর্কে জানলাম। প্লেটগুলোর সংযোগ স্থলই হলো ফল্ট লাইন। প্লেট গুলোর সংঘর্ষ থেকেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে প্লেট গুলোর সংযোগ স্থলই হল ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল। ভূকম্পনের উৎপত্তি এই স্থানগুলো থেকে হয় বলে স্থান গুলোকে “ফল্ট লাইন” বলা হয়।

সিসমোগ্রাফ এবং রিখটার স্কেলঃ
যখনই কোথাও ভূকম্পন হয় তোমরা প্রায়ই শুনে থাকো বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প। এই মাত্রা নির্ণয় করা হয় সিসমোমিটার বা সিসমোগ্রাফ দিয়ে। সিসমোমিটার ভূত্বকের কম্পন পরিমাপক যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে প্রধানতঃ ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, বা অন্য যে কোনো কারণে ঘটা ভূত্বক বা ভূগর্ভস্থ কম্পনের তীব্রতা মাপা হয়। এই কম্পন তীব্রতার তথ্য-উপাত্ত ভূতত্ত্ববিদদেরকে ভূগর্ভের মানচিত্র বানাতে, ভূমিকম্পের উৎস এবং তীব্রতা বিশ্লেষণে সাহায্য করে। সিসমোগ্রাফ আবিষ্কারের আগে মানুষ শুধু বলতে পারত ভূমিকম্প হয়ে গেছে। কিন্তু কোন মাত্রায় হলো- বলা সম্ভব ছিল না। আধুনিক সিসমোগ্রাফের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। ভূমিকম্প মাপা হয় দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচণ্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫ এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক মাত্রা বৃদ্ধি পেলেই এর তীব্রতা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রাঃ
৫ – ৫.৯৯ মাঝারি
৬ – ৬.৯৯ তীব্র
৭ – ৭.৯৯ ভয়াবহ
৮ – এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ

রিং অব ফায়ারঃ
প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই অঞ্চলটি দেখতে অনেকটা রিং এর মতো। চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই অঞ্চলে ৪৫২ টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যা ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত মোট আগ্নেয়গিরির প্রায় ৭৫ শতাংশ। কেউ যদি তোমাদের জিজ্ঞাসা করে আগ্নেয়গিরির বাড়ি কোথায়? তোমরা খুব সহজেই বলে দিতে পারবে প্রশান্ত মহাসাগরের “রিং অব ফায়ার” ই হচ্ছে আগ্নেয়গিরিদের আবাসস্থল।

সুনামিঃ
সুনামি জাপানি শব্দ। “সু” শব্দের অর্থ বন্দর আর “নামি” শব্দের অর্থ তরঙ্গ। একসাথে সমুদ্র বন্দরের তরঙ্গ। যখন ভূমিকম্প সাগরের তলদেশে হয় তখন সাগরের পানি উপচে পড়ে তীরবর্তী সবকিছু মুহুর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এটাই সুনামি। ধ্বংসযজ্ঞের দিক দিয়ে সুনামির কোন তুলনা নেই। প্রাকৃতিক দূর্যোগের মধ্যে সুনামি সবচেয়ে ভয়ংকর।

ভূমিকম্প কেন হয়?
ছোটবেলায় গল্প শুনতাম, পৃথিবীটা একটা বড় ষাঁড়ের শিংয়ের মাথায়। ষাঁড়টা যখন এক শিং এ অনেকক্ষন ধরে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে যায় তখন সে শিং বদল করে। যখন এক শিং থেকে অন্য শিংয়ে পৃথিবীটা নিয়ে যায় তখন সবকিছু কেঁপে ওঠে। আর এভাবেই এবং এজন্যই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প নিয়ে নানান দেশে নানান ধরনের লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে…
১. গ্রিক জাতির ধারণা অনুযায়ী তাবৎ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী ভূমিকম্পের দেবতা পোসাইডন। পোসাইডন যখন খারাপ মেজাজে থাকেন, তখন ভূমিতে ত্রিশূল দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করেন। ফলে ভূমিকম্প হয়। মানুষের পাপকাজে রাগন্বিত হয়েও তিনি এরকম করেন বলে প্রচলিত আছে।

২. পশ্চিম আফ্রিকান সংস্কৃতির কিছু মানুষ মনে করত, জীবন টিকে আছে এক দৈত্যের মাথার মধ্যে। গাছপালা সেই দৈত্যের চুল। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী হচ্ছে পরজীবীর মতো, যারা দৈত্যের ত্বকজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে দৈত্যটি মাথা এদিক-ওদিক ঘোরায়। তখনই ভূমিকম্প হয়।

৩. জাপানের লোকজন আবার ভূমিকম্পের সঙ্গে নামাজু নামের মাগুর জাতীয় মাছের সম্পর্ক খুঁজে পায়। তাদের মতে নামাজু কাদার মধ্যে বাস করে। কাশিমা নামের এক দেবতা জাপানকে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করার জন্য স্বর্গীয় শক্তির মাধ্যমে শক্ত পাথর দিয়ে নামাজুকে চেপে ধরে রাখেন। ফলে নামাজু নড়াচড়ার সুযোগ পায় না। যখন কাশিমা তার পাহারা সরিয়ে নেন তখনই নড়ে ওঠে নামাজু। ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।

৪. ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে চারটি বিশালাকৃতির হাতির ওপর। তারা আবার দাড়িয়ে আছে একটি কচ্ছপের ওপর দাঁড়িয়ে। কচ্ছপটি দাড়িয়ে আছে একটি মহিষের দুই শিংয়ের ওপর। এদের মধ্যে যে কোনো একটি প্রাণীর গা চুলকালে তারা নড়াচড়া করে, ফলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়।

যদিও এগুলো শুধুই রূপকথা এবং ভূমিকম্পের কারণ এগুলো কোনটাই নয়, তবে পৃথিবীর গভীরে ঠিকই একটা পরিবর্তন হয়। টেকটনিক প্লেটগুলো যখন একে অপরের উপর উঠে পড়ে, অথবা ধাক্কা খায় অথবা তাদের মধ্যে ঘর্ষনের সৃষ্টি হয় তখনই ভূমিকম্প হয়। এখন প্রশ্ন হলো তারা কেন ধাক্কা খাবে বা তাদের মধ্যে ঘর্ষন হবে অথবা তারা একে অপরের উপর উঠে যাবে?

আমরা আগেই দেখেছি পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে উত্তপ্ত গলিত লাভা উপস্থিত। এই তরল লাভা কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে আসতে চায় কারন পরিধিতে তাপমাত্রা কম থাকে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পরিচলন। পরিচলন পদ্ধতিতে গরম লাভা উপরে উঠে আসে এবং উপরের ঠাণ্ডা লাভা নিচে চলে যায়। এভাবে উপর থেকে নীচে লাভার একটা স্রোত তৈরী হয় যা প্লেটকে ক্রমাগত চাপ দেয় একদিকে সরে যাবার জন্য। কিন্তু প্লেটগুলো একে অপরের সাথে লেগে থাকার দরুন সরতে পারেনা। ফলে সেখানে প্রচুর শক্তি জমা হয়। এভাবে জমানো শক্তি অনেক বেশী হয়ে গেলে প্লেট একটার উপর আরেকটা উঠে পরে সাথে সেই প্রচন্ড শক্তি নির্গত করে ফলে ভূমিকম্প হয়।

এছাড়া সেখানে নানান ধরনের বিক্রিয়ায় নানান গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছে টেকটনিক প্লেটগুলোর উপরে। সেই চাপের তারতম্যও মূলত ক্রমাগত ভূমিকম্পের জন্য দায়ী। সাধারণত টেকটনিক প্লেটের মাঝামাঝি যেসব স্থানের উপস্থিতি সেখানে ভূমিকম্পের তীব্রতা ততটা অনুভূত হয়না। কিন্তু যেসব স্থান দুইটি প্লেটের সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইনে অবস্থিত সেখানে ভূমিকম্পের তীব্রতা অনেক বেশী হয়। কারণ সেখানেই ভূকম্পনের উৎপত্তি।

আবার গলিত লাভা প্রচন্ড শক্তি নিয়ে টেকটনিক প্লেটের নানা স্থানে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। টেকটনিক প্লেটের কোন দূর্বল অবস্থানে আঘাত করে লাভা গুলো প্রচন্ড বেগে পৃথিবীর উপরে উঠে আসে। এই ঘটনাকে আমরা অগ্ন্যুৎপাত বলে থাকি। আর যে পাহাড়ে এই ঘটনা ঘটে থাকে তাকে আমরা আগ্নেয়গিরি বলে থাকি। যখন অগ্ন্যুৎপাত হয় তখনও টেকটনিক প্লেট গুলোর উপর ক্রমাগত ধাক্কার কারণে ভূকম্পন হয়ে থাকে। টেকটনিক প্লেটের এই দূর্বল অবস্থান হলো “রিং অব ফায়ার”।

ফল্ট লাইনে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনটি কারণেই ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই ধরনের ঘটনাকে বিচ্যুতি বলে। তিনটি বিচ্যুতি হল অভিসারী বা এক কেন্দ্রাভিমুখী, রিভার্স বা অপসারী এবং ঘর্ষণ বা স্ট্রাইক স্লিপ বিচ্যুতি। ভূ-অভ্যন্তরের টেকটনিক প্লেটের মাঝে বিচ্যুতি ঘটলে হয় অভিসারী বিচ্যুতি, দুটো প্লেট সঙ্কুচিত হলে ঘটে রিভার্স তথা উল্টো বিচ্যুতি, আর পাশাপাশি সরে গেলে ঘটে স্ট্রাইক স্লিপ তথা ঘর্ষণ বিচ্যুতি।



ফল্ট লাইন ও পাহাড়
লক্ষ লক্ষ ভূমিকম্পের মধ্যে মাত্র ১% আমরা আমাদের নানান যন্ত্র ও টেকনোলজির মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারি। বেশির ভাগ ভূমিকম্প আমরা টেরই পাই না। এর কারণ কী হতে পারে? এর কারণ হলো মহান সৃষ্টিকর্তার দয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন “আমি পাহাড়গুলোকে গেড়ে দিয়েছি পেরেকের মত” (সূরা নাবা:৭), তিনি আরো বলেন “আর আমরা পৃথিবীতে সৃষ্টি করে দিয়েছি পাহাড় পর্বত, যাতে করে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে এদিক সেদিক ঢলে না পরে” (সূরা আম্বিয়া:৩১)। এছাড়া তিনি আরো বলেন “আর তার (পৃথিবীর) মধ্যে মজবুতভাবে গেড়ে দিয়েছেন পাহাড়-পর্বত” (সূরা আন নাজিয়াত:৩২)। আসলেই তাই। প্রত্যেকটি ফল্ট লাইন অনুসন্ধান করে জানা যায় সবগুলো মূল ফল্ট লাইনের ওপরেই পাহাড়ের অবস্থান রয়েছে। পাহাড়ের ভিত্তি অনেক গভীরে থাকে বলে ভূমিকম্পের শক্তি এরা শোষণ করতে পারে তাই আমাদের কাছে সব ভূমিকম্প অনুভূত হয় না। ফল্ট লাইনগুলোর ওপরে পাহাড় গেড়ে দেয়ার কারণে পৃথিবী ক্রমাগত ভূমিকম্পের পরও স্থিতিশীল থাকে।

ভূকম্পন তরঙ্গ
পৃথিবীর অভ্যন্তরে দু’ধরনের তরঙ্গের উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায়। এগুলো সিসমিক ওয়েভ নামে পরিচিত। ভূমিকম্পের পর ভূমধ্যস্থ কেন্দ্রে নানান ধরনের গলিত লাভা, গ্যাস বাষ্প ইত্যাদি চলাফেরা করে সিসমিক ওয়েভ দ্বারা। ভূমিকম্পের পর দুটো ওয়েভ উৎপন্ন হয়, সেগুলো হলো ১. প্রাইমারি ওয়েভ (ভূমিকম্পের শুরুতেই যে তরঙ্গ তৈরি হয়) ২. সেকেন্ডারি ওয়েভ (প্রাইমারি ওয়েভ শুরু হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই সেকেন্ডারি ওয়েভ শুরু হয়)। দুটো ওয়েভই ভয়ঙ্কর। প্রাইমারী ওয়েভ সাধারণত জোরালো হয়। সেকেন্ডারি ওয়েভ তুলনামূলক কমশক্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে সেকেন্ডারি ওয়েভের কারণেই পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ ব্যাপক আকার লাভ করে। যেসব ভূকম্পনের সেকেন্ডারি ওয়েভ শক্তিশালী হয়, সেসব ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।


P-Waves (প্রাইমারি ওয়েভ)


S-Waves (সেকেন্ডারি ওয়েভ)

বাংলাদেশের ভূমিকম্প

বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায়। কারণ বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির (ফল্টলাইন) প্রভাবে আন্দোলিত হয়। কেননা বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মিয়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দু’টি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থান করছে। এখানে আশঙ্কা রয়েছে বড় ধরনের নড়াচড়ার অর্থাৎ বড় ধরনের ভূ-কম্পনের। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে যথা- বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা।

নেপালে কিছুদিন পূর্বে উপমহাদেশের ৬৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দক্ষিু-পূর্ব এশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূকম্পন মাপক সংস্থা ইউএসজিএস নেপালের ভূমিকম্পটিকে ৭.৯ রিখটার স্কেলে নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এই কম্পনের মাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭.৫। এর আগে ১৯৫০ সালে আসামে ৮.৫ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছিল। নেপালের এই ভূমিকম্পের পর ৪ থেকে ৫টি আফটার শক হয় এবং প্রতিটি রিখটার স্কেলে ৬ এর ওপরে ছিল। ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের বাউন্ডারি বরাবর উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্পটি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি হলে পুরো দেশে বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা ছিল। প্রচন্ড শক্তিশালী এই ভূমিকম্পটি আমাদের দেশের ৭৪৫ (ঢাকা থেকে) কিলোমিটার দূরে হওয়ায় যে কম্পন অনুভূত হয়েছে তা যদি সীমান্তের আশপাশে হতো সেটা চিন্তা করে শিউরে উঠছি।

নিকট ইতিহাসে সব থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয় দক্ষিু চিলিতে। ২২ মে, ১৯৬০ সালের এই ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির জেরে কমপক্ষে ১,৭১৬ জনের মৃত্যু হয়। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৯.৫।

এবার এসো আমরা জানার চেষ্টা করি ভূমিকম্পের সময় আমাদের করণীয় কী?

ভূমিকম্পের আগে করণীয়
১. বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে নিরাপদ স্থানগুলো আগে থেকেই চিহ্নিত করে রাখো। যাতে ভূমিকম্পের সময় ভাবতে না হয় কোথায় আশ্রয় নেবে। বাসায় যারা ছোট তাদেরকে ভাল করে বুঝিয়ে দাও।

২. ভঙ্গুর জিনিস সবসময় বন্ধ শেলফে রাখা উচিত।

৩. ভারী মালপত্র শেলফের নিচের দিকে রাখা ভালো।

৪. লিক হওয়া গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন মেরামত করে নাও এবং নিয়মিত পরীক্ষা করবে।

৫. মাঝে মাঝে মহড়া দাও যাতে সবাই আয়ত্ত করতে পারে।

৬. নিজের বাসায় সচেতন করো, সাথে তোমার কমিউনিটিকেও।

ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতরে থাকলে করণীয়

১. ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সাথে সাথে শক্ত-মজবুত কোন আসবাবপত্রের তথা শক্ত টেবিল খাট প্রভৃতির নিচে ঢুকে যেতে পারো এবং সেটিকে হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো যাতে সরে না যায়। এতে করে ভূমিকম্পের ফলে ঘরের কোন জিনিস মাথার উপর পড়তে পারবে না। মনে রাখবে, আমাদের দেহের মধ্যে মাথা হল সবচেয়ে নমনীয় অঙ্গ, মাথা রক্ষা করার চেষ্টা করবে।

২. আসবাবপত্র না পেলে ঘরের ভেতরের দিকের দেয়ালের নিচে বসে আশ্রয় নিতে পারো। বাইরের দিকের দেয়াল বিপজ্জনক। বিমের নিচে দাঁড়াবে। কারণ- ছাদের কোন অংশ ভাঙ্গলেও বিম এত সহজে ভাঙ্গবে না।

৩. জানালার কাচ, আয়না, আলমারি, দেয়ালে ঝুলানো বস্তু থেকে দূরে থাকবে।

৪. বহুতল ভবনের উপরের দিকে অবস্থান করলে ঘরের ভেতরে থাকাই ভাল। কারণ, নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর পূর্বেই ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।

৫. ভূকম্পন থেমে গেলে বের হয়ে আসবে।

৬. নিচে নামতে চাইলে কোনোভাবেই লিফট ব্যবহার করবে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামবে। নামার সময় মোবাইল ফোন আর ঘরের চাবিটা সম্ভব হলে হাতে নিয়ে নেবে।

৭. বিছানায় শোওয়া অবস্থায় থাকলে বেশি দূরে না গিয়ে খাটের নিচেই আশ্রয় নাও।

ঘরের বাইরে থাকলে করণীয়

১. খোলা জায়গা খুঁজে আশ্রয় নাও।

২. লাইট পোস্ট, বিল্ডিং, গাছ অথবা বৈদ্যুতিক পোলের নিচে দাঁড়াবে না।

৩. রাস্তায় ছোটাছুটি করবে না। মাথার উপর কাচের টুকরা, ল্যাম্পপোস্ট অথবা বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

চলমান গাড়িতে থাকলে করণীয়

১. গাড়ি থামিয়ে খোলা জায়গায় পার্ক করে ভেতরেই আশ্রয় নাও।

২. কখনই ব্রিজ, ফ্লাইওভারের উপরে বা নিচে থামবে না।

৩. ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই অপেক্ষা করতে থাকো।

ভূমিকম্পের পরে করণীয়

১. ভূমিকম্প শেষ হলেও আরও একটি-দু’টি মৃদু কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকো। এই আফটার শকের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবার হতে পারে।

২. যথাসম্ভব শান্ত থাকবার চেষ্টা করবে। কম্পন থেমে গেলেও কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তারপর বের হবে।

৩. নিজে আহত হয়েছ কিনা পরীক্ষা করো, অপরকে সাহায্য করো।

৪. বাড়িঘরের ক্ষতি পর্যবেক্ষু করো। নিরাপদ মনে না হলে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যাও।

৪. গ্যাসের সামান্যতম গন্ধ পেলে জানালা খুলে দেবে এবং দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ যে কোন সময় আগুন লাগতে পারে।

৫. কোথাও বৈদ্যুতিক স্পার্ক চোখে পড়লে মেইন ফিউজ বন্ধ করে দেবে।

ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে করণীয়

১. আগুন জ্বালাবে না। বাড়িটিতে গ্যাসের লাইন লিক থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

২. হাত অথবা রুমাল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নেবে।

৩. ধীরে নড়াচড়া করবে এবং উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকবে।

৪. উদ্ধার কাজের সময় নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পাইপ অথবা দেয়ালে টোকা দিয়ে শব্দ করবে। চিৎকার না করাটাই শ্রেয় এতে প্রচুর পরিমাণে ধুলা নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে যেতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট হয়ে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

উপরের করণীয়গুলো আমরা সবাই মোটামুটি জানি। কিন্তু বিপদের সময় মনে থাকে না। আশা করি আমরা সবাই সচেতন থাকবো এবং বাসার সবাইকে সচেতন রাখবো। সেই সাথে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করবো।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন