মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০১৬

বজ্রপাতের আচার সমাচার


ছোটবেলায় পল্লী কবি জসীম উদদীনের মামার বাড়ি কবিতা সবার পরিচিত। সত্যি ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে সুখ হতো যদি বজ্রপাতের ভয় না থাকতো। সৃষ্টিকর্তার সুপরিকল্পিত সৃষ্টির মাঝে বজ্রপাত একটি সাধারণ ঘটনা।


পানিচক্রের নিয়মে জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে উড়ে যায়। এরপর জলীয়বাষ্প ঠান্ডা ও ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয় ।

এই জলীয় বাষ্পযুক্ত আদ্র বায়ু যখন সমুদ্র থেকে প্রবাহিত হয়ে স্থলভাগে বাহিত হয়, তখন বাতাসের প্রতিটি আদ্র কণা ধনাত্মক (+ve) চার্জযুক্ত ইলেক্ট্রন বহন করে। আর অন্যদিকে স্থলভাগের বায়ু থাকে শুষ্ক এবং ঋণাত্মক (-ve) চার্জযুক্ত। প্রতিটি ইলেক্ট্রণের কণা আবার একেকটা খাপের মধ্যে আটকা থাকে। অনেকটা শামুকের খোলসের মত। এই দুই বিপরীত চার্জযুক্ত বায়ু কণা যখন সংঘর্ষে আসে তখন পজেটিভ চার্জযুক্ত কণাগুলো তাদের নিজস্ব খোলস থেকে বেরিয়ে নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণার খোলসে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে যায়।

আবার জলীয়বাষ্প ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার সময় বায়ু ও অন্য জলীয় কনার সাথে ঘর্ষণের ফলেও এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ (electrostatic charge) জমা হয়। এই মেঘ-ই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ বৈদ্যুতিক চার্জ্ররে আধারের মত আচরণ করে।


পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশঃ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘণীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প কণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় তা পজেটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের উপর পৃষ্ঠে এবং ভারী নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণচার্জ জমা হওয়ার পর পজেটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরষ্পরকে আকর্ষণের দরুণ electrostatic discharge প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই মুক্ত ইলেকট্রন গুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপরপৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটর এর বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরের চার্জ তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জে পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বায়ূমন্ডলের উপরের অংশে নীচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায় যে, নীচের দিক থেকে উপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়।


এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড (Thunder Clouds) বলে । আর উপরে উঠতে উঠতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে পানির পরিমাণ যখন প্রায় ৫ মি:মি: এর বেশী হয়, তখন পানির অনুগুলো আর পারস্পারিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। তখন এরা আলাদা (Disintegrate) হয়ে যায়।

সাধারণত মেঘের উপরের অংশ পজিটিভ এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জে চার্জিত থাকে এবং মেঘের দুইটা দিকের একটা থাকবে নিচের দিকে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের দিকে এবং অন্য অংশ থাকবে উপরের দিকে তথা মহাকাশের দিকে। মেঘের নিচের অংশে সাধারণত ঋণাত্মক আয়ন আর উপরের অংশে থাকে ধনাত্বক আয়ন। 



এখন আমরা ভূপৃষ্ঠের কথা বিবেচনা করি। ভূপৃষ্ঠের মধ্যকার ধনাত্মক আয়নই মূলত ভূপৃষ্ঠের বজ্রপাতের কারণ। যখন আকাশে প্রচুর মেঘ জমে আর তা ভূপৃষ্ঠের খুব নিকটে চলে আসে তখনই বজ্রপাতের ঘটনাটা ঘটে।

মুলত: মেঘের নিচের অংশে প্রচুর ঋণাত্মক আয়ন অবস্থান করছে যেগুলো অধিক পরিমাণ হয়ে যাওয়ায় অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর এই আয়নগুলো যেহেতু ঋণাত্মক, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি কোন ধনাত্মক পথের দিকে ছুটে যেতে চাইবে। যার ফলশ্রুতিতে এগুলো ভূপৃষ্ঠের ধনাত্মক আয়নের দিকে দ্রুত ধাবিত হয়। কেননা আমরা জানি ধনাত্মক-ঋণাত্মক একে অপরকে আকর্ষণ করে।

ঋণাত্মক আয়নের আগমন দেখে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন পদার্থ থেকে সৃষ্ট ধনাত্মক আয়নগুলোও আর নিজেদের অবস্থানে থাকতে পারে না। এগুলোও তখন যথাসম্ভব উপরের দিকে উঠে যায়।

আর যখনই মেঘে অবস্থিত ঋণাত্মক আয়ন আর ভূপৃষ্ঠের ধনাত্বক আয়নগুলো একে অপরের সংস্পর্শে আসে তখন ইলেক্ট্রনগুলো যাওয়ার রাস্তা খুজে পায়। তখনই পজেটিভ ও নেগেটিভ চার্জ সংঘর্ষে আলো জ্বলে উঠে আর মেঘের ইলেক্ট্রনগুলো দ্রত ভূপৃষ্ঠের চলে যায়। একেই আমরা বজ্রপাত বলি।

বিভিন্ন প্রকার বজ্রপাত
বজ্রপাত সাধারণত দুইটি পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। মেঘ ও পৃথিবীর আর মেঘ দ্বয়ের নিজেদের মধ্য। যখন বিশাল চার্জ যুক্ত মেঘ কোন অবজেক্ট যেমন ইলেটিক টাওয়ার, উচু দালান, মসজিদ বা মন্দিরের মিনার, বড় গাছপালার উপর কিছুক্ষণ অবস্থান কালে অবজেক্ট এবং মেঘের মধ্যে বায়ুর আদ্রতা বৃদ্ধিপায় ।এর ফলে বাতাসের ইলেকট্রন প্রবাহ ক্ষমতা বাড়তে থাকে। এক সময় মেঘ ও অবজেক্টরে মধ্যে ৫ হতে ১০ লক্ষ পটেনশিয়াল ব্যবধান ঘটে তখন বাতাসের ইনসুলেশন ভেঙ্গে ইলেট্রিক ডিচার্জ ঘটে।

আর একপ্রকার স্টোক সাধারনত কোন উচু স্থান প্রয়োজন হয়না। নিজেদের মধ্য ডিচার্জ মাধমে এই ধরনের বজ্রপাত হয়। এর তীব্রতা অন্য স্টোকের তুলনায় কম শক্তিশালী হয়। এই ধরনের বজ্রপাতের জন্য নূন্যতম তিনটি চার্জ যুক্ত মেঘ খন্ড প্রয়োজন হয়।


উপরের চিত্রে ক, খ, গ তিনটি মেঘ। ক এবং খ পজেটিভ এবং গ নেগেটিভ চার্জ যুক্ত। মেঘ খ এবং গ পরস্পর কে আকর্ষনের মাধ্যমে ভারসাম্য অবস্থায় থাকে। কিন্তু বাতাসের কারণে যখন ক মেঘের আগমনের ফলে খ এরং গ এর অকর্ষণ কমে যায়। এর ফলে ক এরং খ এর মধ্য ফ্লাশওভার ঘটে এরং গ বিচ্ছন্ন হয়ে আর্থে(Earth) বজ্রপাত আকারে আছড়ে পড়ে। এর তীব্রতা ১০ থেকে ৯০ কিলো ভোল্ট হয়ে থাকে। এই ধরনের স্টোক কে ইনডিউস স্টোক বলা হয় ।

বজ্রপাতের সময় আলো জ্বলে কেন
বজ্রপাতের সময় আমরা আলোর ঝলকানি (Lightning) দেখতে পাই। এসময় বাতাসের তাপমাত্রা ২০ হাজার ডিগ্রী থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর ফলে মেঘের ভিতর থাকা নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের সমপ্রসারণ ঘটে।(উল্লেখিত তাপ এবং আলো এরা কিন্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাপ এবং আলো একই শক্তির দুই রূপ)। প্রচন্ড তাপসৃষ্টির ফলে অকস্মাৎ সে স্থানের বায়ু অনেক বেশি স্ফিত হয়ে যায়। আবার যখন ইলেকট্রনর কণাগুলো খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন আবার সেখানকার তাপমাত্রা একেবারে হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়। এ সময় উক্ত এলাকার বাতাসের প্রসারণ (Expansion) এবং সংকোচণেড় (Contraction) ঘটে। এই যে অকস্মাৎ বায়ুর স্ফীতি এবং সংকোচন ঘটে, এতে একটি বিশাল ঢেঊ বা তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। বাতাসের এই ঢেউই মূলত আমরা শব্দ বা বজ্রধ্বনি হিসেবে শুনি। আমরা সবাই জানি বাতাসের তরঙ্গের ফলে শব্দ তৈরি হয় এবং শুনতে পাই মেঘের গর্জন। আর আলো ও শব্দের গতির তারতম্যর কারণে আলো আগে দেখতে এরং শব্দ পরে শুনতে পাই।

বজ্রপাতের সময় আলো জ্বলে, এর কারণ হল ইলেক্ট্রন যাওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত করে, এবং কিছুটা আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আর এ সময় বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আমরা জানি বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী। কিন্তু মেঘে জমা হওয়া স্থির বিদ্যুৎ এত উচ্চ বিভব শক্তি (১০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত) উৎপন্ন করে যে, তা বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার জন্য বাতাসের একটা সরু চ্যানেলকে আয়নিত করে পরিবাহী পথ (conductive path) তৈরি করা হয়। আয়নিত পরমাণু থেকে বিকীর্ণ শক্তি তীব্র আলোক ছটা তৈরি হয়।

আলো এবং শব্দের বেগের পার্থক্যের মাধ্যমে আপনার কাছে থেকে কত কি:মি: দূরে বজ্রপাত হয়েছে তা সহজেই জানতে পারবেন। বিজলি চমকানোর থেকে শব্দ শোনর সময়েকে তিন দিয়ে ভাগ করলে প্রাপ্ত ফলই ঐ দূরত্ব। 

বজ্রপাতের মৌসুম
মার্চ থেকে এপ্রল মাস পর্যন্ত সাধারণত বিহারের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তখন বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাস্প পূর্ন বায়ু প্রবাহ এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এই ছুটে আসা আদ্র বায়ু প্রবাহ এই দুয়ের সংঘাতে একটি দুটি করে বজ্র মেঘের সৃষ্ট হয়।




আর সেগুলি তীব্র গতিতে মাথা তুলতে থাকে। এই মেঘগুলি থেকে নিঃসৃত শীতল ঝড়ের জাপটা (Cold down draft) সামনের দিকে আঘাত করে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আদ্র বায়ু ঐ ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে ওপরে উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গায় নতুন করে বজ্র-মেঘ সৃষ্টি হয়।


সবচেয়ে প্রথম যে একটি দুটি মেঘ তৈরী হয়েছিল তাদেরকে জননী (Mother Thunder Storm) বলা হয়। তবে সামনের দিকে সৃষ্টি হওয়া নতুন বজ্র-মেঘ গুলো কে বলা হয় কন্যা (Daughter Thunder Storm)। এই ভাবে সামনের দিকে ক্রমে অনেক গুলি বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়ে একটা রেখা বরাবর দক্ষিন-পূর্ব দিকে এগোয়।

যে, কালবৈশাখী মেঘের এই রেখাটি (Line Squacl Cloud) ক্রমে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিন-পূর্বে আগায়। এই রেখার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ কি:মি: পর্যন্ত হয়। আর বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫- থেকে ২০ কিঃমিঃ’র মত হয়। এই রেখাটি যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে ঝাপটা দিয়ে যায়, সেই অঞ্চলেই কালবৈশাখীর তান্ডবলীলা চলে। ক্রমে ক্রমে এই মেঘ বঙ্গোপসাগরের কাছে পড়লেই এই কাল কালবৈশাখী ঝড় নিস্তেজ হয়ে যায়।কারণ সমুদ্রের ওপর কালবৈশাখী হয় না।


সাধারণত কালবৈশাখী মেঘের বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫-২০ কি:মি: এর মতো। এবং মেঘগুলি সাধারণত প্রতি ঘন্টায় ২৫-৩০ কি:মি: গতিতে এগোয়। সুতরাং কোন কোন স্থান অতিক্রম করতে এই মেঘগুলির সাধারনত আধঘন্টা থেকে বড়জোর এক ঘন্টার মতো সময় লাগে। বৃষ্টি ততক্ষণ হয়। কিন্তু বজ্র মেঘের সঙ্গে অনেক সময় মধ্যস্তর মেঘ থেকেও অনেক সময় বৃষ্টি হয়। এই জন্য কোন কোন সময়ে এক ঘন্টারও বেশী সময় বৃষ্টি হতে পারে। 

বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎ সংরক্ষন
বজ্রপাত থেকে উৎপন্নবিদ্যুৎ শক্তি জমা করতে পারলে একটি পরিবার ১৮৫ মাস বা, প্রায় ১৫ বছর বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন।

চাইলে আপনিও বজ্রপাতকে ট্র্যাপে ফেলে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহারের সুযোগ লুফে নিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে বজ্রপাত ঘায়েল করতে আপনি সময় পাবেন এক সেকেন্ডেরও কম (কারণ বজ্রপাতের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে)।

বজ্রপাত নিয়ে গবেষনায় থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। বজ্রপাত থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ তড়িৎ শক্তিকে ধারণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বজ্রপাতের ভয়াবহতা
বাংলাদেশের অবস্থান বজ্রপাত প্রবণ অঞ্চলে। তাছাড়া বজ্রপাত বন্ধ বা প্রতিরোধে কোনো উপায় নেই, কারণ এটা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। তবে বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষতি কমিয়ে আনা কিংবা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। বজ্রপাতে প্রতিবছর শতাধিক তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। এ ছাড়া মূল্যবান ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বুঝতেই পারছেন না এর কারণ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক বজ্রপাতে হতাহতের খবরের পর এমনই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বজ্রপাতের তাপমাত্রা থাকে ৪০ হাজার ডিগ্রী সেন্ট্র্রিগ্রেট। ঘণ্টায় প্রায় ২লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার গতিবেগ থাকে। বজ্রপাতের দৈর্ঘ্যে ১‘শ মিটার থেকে ৮ কিলোমিটার, ব্যসার্ধে ১০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এতে ১০ কিলো থেকে ১ কোটি পর্যন্ত ভোল্ট থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি অক্ষুন্ন রাখার জন্য বজ্রপাত প্রাকৃতিক চার্জ হিসেবে কাজ করে। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ থেকে ১০০ টি বজ্রপাত হয়।

বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশকে বজ্রপাতপ্রবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চৈত্র-বৈশাখে কালবেশাখীর মওসুম শুরু হলেই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটতে থাকে।

গত মাসে প্রায় শতাধিকেরও বেশি মানুষ বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। প্রতি বছরই এই মওসুমে বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটে। ২০১৪ সালেও সারাদেশে প্রায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৩ সালে একদিনেই ১০ জেলায় ১৮ জন নিহত হন।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ঘটে ২০১২ সালে। ওই বছরের ১০ আগস্ট সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সরস্বতীপুর গ্রামের মসজিদে বজ্রপাতে ইমামসহ ১৩ জন মুসলির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

আর সারাবিশ্বে বজ্রপাতের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ঘটে ১৭৬৯ সালে। ইতালির একটি চার্চে বজ্রপাতে গান পাউডার বিস্ফোরিত হয়। এতে তিন হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বজ্রপাত পুরোপুরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগ প্রতিহতের উপায় নেই। তবে রয়েছে রক্ষা পাওয়ার কৌশল।

সে বিষয়েই কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। মাটি বা ছনের ঘরকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করতে ঘরের উপর দিয়ে একটি রড টেনে তার সঙ্গে দুই দিকে দুটি রড খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ ঘরকে আক্রান্ত না করে রডের ভেতর দিয়ে মাটিতে চলে যাবে। একে লাইটিং এরেস্টার বলা হয়।


ইটের তৈরি অট্টালিকাকেও নিরাপদ রাখা যায়। তবে এখানে কিছুটা ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। এতে ভবন ও ভেতরে থাকা ইলেট্রনিক পণ্য নিরাপদ রাখা সম্ভব। এখানে ভবনের উপরে লৌহদন্ড বসিয়ে দিয়ে পাশ দিয়ে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।

অনেক ভবনেই উপরে লৌহদন্ড বসানো হচ্ছে কিন্তু এর সঙ্গে একটি তার দিয়ে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত না করে, ভবনের আভ্যন্তরীন রড়ের মাধ্যমে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় যা উচিত নয়। সাধারণ বিদ্যুৎ কোনো পরিবাহীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিংয়ের তত্ত্ব মতে, বজ্রপাত কেন্দ্রস্থল দিয়ে প্রবাহিত না হয়ে ত্বক দিয়ে পরিবাহিত হয়। তাই দেয়ালের ভেতর দিয়ে বজ্রপাত নিরোধক স্থাপন খুব কার্যকর হয় না।

যারা মনে করেন ভবনের ভেতরে অবস্থান করলে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকা যায় তাদের ধারণাও ভুল, কারণ প্রত্যেকটি ভবনের ছাদে পানির ট্যাংক বসানো থাকে। এই ট্যাংকের ওপর বজ্রপাত হলে সে সময় কেউ কলে পরিবাহিত পানি ব্যবহার করতে থাকলে তার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ বজ্রপাতের বিদ্যুৎ পানির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। ভবনের গা বেয়ে যদি বজ্রপাত চলে যায় সেক্ষেত্রে গ্রিলের সংস্পর্শে কেউ থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া ডিসের ক্যাবলসহ অন্যান্য ক্যাবলের মাধ্যমেও ঘরের ভেতরে থাকা পয কেউ এর শিকার হতে পারেন।

তবে ঘরে নয়, ঘরের বাইরে খোলা মাঠেই বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে। বজ্রপাতের সময় কেউ খোলা মাঠে থাকলে কোনো গাছের নিচে আশ্রয় না নিতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বজ্রাহত না হলেও উচ্চশব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। তাই সম্ভব হলে কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হাতে ধাতব বস্তুু থাকলে (আংটি, চাবি, কাস্তে, কোদাল, মোবাইল) তা অন্তত ৬০ ফুট দূরে ছুঁড়ে দিতে পারলে ঝুঁকি কমে যায়। কারণ বজ্রপাত আশপাশের ধাতব পদার্থকে আকর্ষণ করে। সে কারণে হাতে কাস্তে-কোদাল থাকলে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এগুলো সরিয়ে রাখা উচিৎ। তাপমাত্রার ওঠানামার সঙ্গেও রয়েছে বজ্রপাতের ঝুঁকির সম্পর্ক। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেলে বজ্রপাতের ঝুঁকি ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। একটি বিস্লেষণে বলা হয়েছে প্রতি এক দশকে ০.২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ছে।

২০১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে পৃথিবীর উপরিতলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী ্রসেলসিয়াস বেড়েছে। এতে বজ্রপাতের ঝুঁকিও বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

বজ্রপাতে হতাহতের সবচেয়ে বড় কারণ সচেতনতার অভাব এমন মন্তব্য করে আবহাওয়াবিদরা তারা বলেন, একমাত্র সচেতনতাই পারে সুরক্ষা দিতে। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোডে একটি শর্ত রাখা হলেও তা স্পষ্ট বা জোড়ালো নয়। বিষয়টিতে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সাবধানতা
বজ্রপাতে থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সাবধানতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ভূমিকম্পের মতো বজ্রপাতেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কিছু শেষে করে দেয়।

সাধারনণ বজ্রপাতে কোন অবজেক্ট পতিত হয়ে শীর্ষ বিন্দু হতে ৪৫ ডিগ্রী কোণে প্রভাব বিস্তার করে। তাই উক্ত দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ।

১.দালান বা পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নিন

ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটি পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে।

২. উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুৎ লাইন থেকে দূরে থাকুন

কোথাও বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেবেন না। খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন একটি যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে।

৩. জানালা থেকে দূরে থাকুন

বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর থাকুন।

৪. ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা

বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করেও বহু মানুষ আহত হয়।

৫. বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র থেকে সাবধান

বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখুন।

৬. গাড়ির ভেতর থাকলে

বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। গাড়ির কাঁচেও হাত দেবেন না।

৭. খোলা ও উঁচু জায়গা থেকে সাবধান

এমন কানো স্থানে যাবেন না, যে স্থানে আপনিই উঁচু। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যান। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যান।

৮. পানি থেকে সওে আসুন

বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সরে পড়ুন। পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।

৯. পরস্পর দূরে থাকুন

কয়েকজন মিলে খোলা কোনো স্থানে থাকাকালীন যদি বজ্রপাত শুরু হয় তাহলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০ ফুট দূরে সরে যান। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান।

১০. নিচু হয়ে বসুন

যদি বজ্রপাত হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসুন। চোখ বন্ধ রাখুন। কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়বেন না। মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

১১. বজ্রপাতের আগ মুহূর্তের লক্ষণ জানুন

আপনার উপরে বা আশপাশে বজ্রপাত হওয়ার আগের মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষণে তা বোঝা যেতে পারে। যেমন বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাড়া হয়ে যাবে, ত্বক শিরশির করবে বা বিদ্যুৎ অনুভূত হবে। এ সময় আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। অনেকেই এ পরিস্থিতিতে ‘ক্রি ক্রি’ শব্দ পাওয়ার কথা জানান। আপনি যদি এমন পরিস্থিতি অনুভব করতে পারেন তাহলে দ্রুত সরে পড়–ন।

১২. রবারের বুট পরিধান করুন

বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।

১৩. বাড়ি সুরক্ষিত করুন

আপনার বাড়িকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। এজন্য আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।

১৪. বজ্রপাতে আহত হলে

বজ্রপাতের সময় আশপাশের মানুষের খবর রাখুন। কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসক কে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। একই সঙ্গে এ সময় বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখুন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন